শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

জনশক্তি রফতানিতে সাফল্য

প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৭ পিএম, ৩১ অক্টোবর, ২০১৬

শামসুল ইসলাম : জনশক্তি রফতানিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের পর জনশক্তি রফতানিতে সাফল্যের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। গত ১০ মাসে বিভিন্ন দেশে ৬ লক্ষাধিক পুরুষ-মহিলা কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লক্ষাধিক মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। জনশক্তি রফতানিতে এ রূপ সাফল্য ধরে রাখতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের পর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এখন উন্মুক্ত হবার পথে। শুধু সিন্ডিকেট চক্রের কালো থাবার কারণে সম্ভাবনাময় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের পর্দা উঠছে না। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (কেডিএন) কর্তৃপক্ষ গত দু’মাসে বাংলাদেশ থেকে নতুনভাবে কর্মী নিয়োগের প্রায় ৫০ হাজার অ্যাপ্রুভাল দিয়েছে। আরো প্রায় ৪০ হাজার কর্মী নিয়োগের জন্য লেভী জমা দেয়ার অনুমতি দিয়েছে কেডিএন। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে এসব অ্যাপ্রুভালের ফাইল জমা নিচ্ছে না। জনশক্তি রফতানির গতিবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিএমইটি’র মহাপরিচালক সেলিম রেজা গতকাল তার দপ্তরে ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সউদী আরবে রাষ্ট্রীয় সফরের পর সউদীর শ্রমবাজার খুলছে। সউদী আরবে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে এখন প্রচুর নারী-পুরুষ কর্মী যাচ্ছে। কাতার ও ওমানেও প্রচুর কর্মী যাচ্ছে। বিএমইটি’র মহাপরিচালক বলেন, বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের কর্মদক্ষতা ও একনিষ্ঠার কারণে জনশক্তি রফতানিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। সরকারের গৃহীত জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি সংক্রান্ত নীতির কারণেও বিদেশে কর্মী গমনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারও উন্মুক্তকরণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলামের উদ্যোগে থাইল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া ও রাশিয়া জনশক্তি রফতানির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এসব মহিলা গৃহকর্মীর সউদী আরবে যাওয়ার প্রক্রিয়া সস্পন্ন করতে এবং রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কমিশন বাবদ প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার বাংলাদেশে এসেছে। প্রবাসে মহিলা গৃহকর্মীরা প্রতি মাসে বেতন হিসেবে জনপ্রতি আড়াইশ’ মার্কিন ডলার করে প্রায় ২ কোটি মার্কিন ডলার গত ১০ মাসে দেশে পাঠিয়েছে। জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার সউদী আরবে মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের সংখ্যা সর্বাধিক। নানা সমস্যার কারছে যদিও কিছু কিছু মহিলা গৃহকর্মী স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশে ফিরে আসছে। মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণে সরকার বাছাই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু সর্তকতামূলক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
বিগত জুন মাসে সউদী আরবে রাষ্ট্রীয় সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সউদী বাদশার সাথে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশ থেকে অধিকহারে কর্মী নেয়ার অনুরোধ জানান। এর পর থেকেই সউদীর শ্রমবাজার চাঙ্গা হতে থাকে। দীর্ঘদিন জনশক্তি রফতানি বন্ধ থাকার পর দেশটিতে এখন মহিলা গৃহকর্মীর পাশাপাশি দেদারসে পুরুষ কর্মীরাও যাচ্ছে। মহিলা গৃহকর্মীর আওতায় বিনা খরচে হারেস (দারোয়ান), মালি, বাসা-বাড়ীর ড্রাইভার সউদী আরবে যাচ্ছে। সউদী আরবের বিভিন্ন খাতেও বাংলাদেশী কর্মী যাচ্ছে। বিএমইটি’র সূত্র জানায়, গত জানুয়ারী থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬ লাখ ১ হাজার ৩শ’ ৪ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৪শ’ ৬জন কর্মী চাকরি লাভ করেছিল। চলতি বছরের শুধু আগস্ট মাসেই বিভিন্ন দেশে ৬৯ হাজার ১শ’ ৯০ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে।
শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার সারাদেশের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে (টিটিসি) গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ২৪টি দেশের ২৮টি লেবার উইংকে গতিশীল করার লক্ষ্যে কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ফলে বিদেশে বাংলাদেশী লেবার উইংগুলো শ্রমবাজারকে চাঙ্গা করে তুলতে ইতিমধ্যেই বিদেশী বিনিয়োগকারী ও জনশক্তি আমদানিকারকদের সাথে দৌড়ঝাঁপ শুরু করছে। প্রবাসী মন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ অন্যান্য জেলার কর্মসংস্থান অফিসে বিদেশ গমনেচ্ছুদের ফিঙ্গারসহ ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে ঐ অঞ্চলের বিদেশগমনেচ্ছু কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে। বিদেশগমনেচ্ছু কর্মীর এখন অহেতুক বিড়ম্বনা ও হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী’র পিএস মুহাম্মদ মহসিন চৌধুরী এ তথ্য জানান। পিএস মহসিন চৌধুরী বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার মুক্তকরণের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জনশক্তি রফতার গতি দিন দিন বাড়ছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র উদ্যোগে থাইল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ায় শ্রমবাজার চালুর চেষ্টা চলছে।
বিএমইটির তথ্য মতে, গত ১ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সউদী আরবে ১০ হাজার ১শ’ ৯৫ জন, ওমানে ১৪ হাজার ৬শ’ ৭৯ জন, কাতারে ১০ হাজার ৩৯ জন, বাহরাইনে ৬ হাজার ৩শ’ ৪৫ জন, সিঙ্গাপুরে ৪ হাজার ২শ’১৮ জন, কুয়েতে ৩ হাজার ৫শ’ ৫৬ জন, লেবাননে ১ হাজার ৪শ’ ২৯ জন, জর্ডানে ১ হাজার ৪শ’ ১ জন, মালদ্বীপে ৭শ’ ৯৩ জন, ব্রুনাইয়ে ৫শ’ ১৬ জন ও মরিশাসে ২শ’ ৩৯ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এছাড়া গত জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সউদী আরবে শুধু ৫২ হাজার ৬শ’ ২৬ জন মহিলা গৃহকর্মী, জর্ডানে ১৭ হাজার ৩শ’২৫ জন মহিলা গৃহকর্মী, ওমানে ১০ হাজার ১শ’ ২০ জন মহিলা গৃহকর্মী ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪ হাজার ৭৬ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪শ’ ৭১ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। ২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪শ’৫২ জন কর্মী চাকরি লাভ করে। একই বছর দেশটির সরকার নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া স্থগিত ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত শুধুমাত্র ১৪ হাজার ২শ’৪১ জন মহিলা গৃহকর্মী বাংলাদেশ থেকে নেয়। দেশটিতে পুরুষ কর্মী নিয়োগ এখনো বন্ধ রয়েছে। সরকারী প্রচেষ্টায় অতিসম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। এ প্রতিনিধি দল তাদের সরকারের কাছে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার ব্যাপারে তাদের মতামত তুলে ধরবে। এদিকে, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভালের ফাইল ১৫টি সোর্স কান্ট্রির মিশনগুলো নিয়মিত জমা নিচ্ছে এবং দ্রুত সত্যায়িত করে দিচ্ছে। একমাত্র নতুন সোর্স কান্ট্রি বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের চাপের মুখে নতুন কর্মী নিয়োগের ইস্যুকৃত অ্যাপ্রুভালের ফাইল জমা নিচ্ছে না। এসব অ্যাপ্রুভাল নিয়ে কুয়ালালামপুরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে নিয়োগকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। গতকাল সোমবার মালয়েশিয়া থেকে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। মালয়েশিয়ায় যাতে সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী প্রেরণের সুযোগ পায় তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জনশক্তি রফতানিকারকরা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কথিত সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। প্রবাসী মন্ত্রী একাধিকবার ঘোষাণা দিয়েছেন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কোনো সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেয়া হবে না। প্রবাসী মন্ত্রী ইতিপূর্বে ৭৪৫টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির নামের তালিকা মালয়েশিয়া সরকারের কাছে প্রেরণ করেছেন। মালয়েশিয়ার কেডিএন কর্তৃপক্ষ গত দু’মাস থেকে বাংলাদেশসহ ১৬টি সোর্সকান্ট্রি থেকে কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভাল দেদারসে সরবরাহ করছে। একমাত্র সরকারী নিদের্শনার অভাবে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ ইস্যুকৃত অ্যাপ্রুভাল রিসিভ করছে না। এতে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী কোম্পানীগুলো চরমভাবে ক্ষুব্ধ হচ্ছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হলে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। প্রবাসী কর্মীরা ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হবে। শিগগিরই কর্মী নিয়োগের নতুন ইস্যুকৃত অ্যাপ্রুভাল রিসিভ করে সত্যায়িত করার প্রক্রিয়া শুরু করা না হলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হাত ছাড়া হতে পারে বলেও অভিজ্ঞ মহল মতামত ব্যক্ত করেছেন।
অতিসম্প্রতি বিএমইটি’র মহাপরিচালক সেলিম রেজা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু প্রসঙ্গে বলেন, যে সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়া থেকে কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আনতে পারবে তাদেরকেই সার্বিক সহয়তা দেয়া হবে। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া কোনো সিন্ডিকেট চক্রের হাতে চলে যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক সেলিম রেজা বলেন, কর্মী নিয়োগে কোনো সিন্ডিকেট চিনি না। মহাপরিচালক বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের জন্য সরকার ৭শ’ ৪৫টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির নামের তালিকা মালয়েশিয়া সরকারের কাছে প্রেরণ করেছে। যে সব রিক্রটিং এজেন্সি মালয়েশিয়া থেকে নিজের যোগ্যতায় কর্মী প্রেরণের চাহিদাপত্র নিয়ে আসতে সক্ষম হবে আমরা তাদের সার্বিক সহযোগিতা দিবো। বিএমইটি’র মহাপরিচালক সেলিম রেজা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, অনলাইনের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ১৪টি মেডিকেল সেন্টারকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া সরকার অতিসম্প্রতি ৬টি সফটওয়ার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করেছে। মহাপরিচালক সেলিম রেজা বলেন, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে প্রচুর বাংলাদেশী কর্মীর চাহিদা রয়েছে। এ শ্রমবাজার হাত ছাড়া হতে দেয়া যায় না।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের মার্চ মাস থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে। বহু কূটনৈতিক তৎপরতার পর ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের জি টু জি প্রক্রিয়ায় শুধু প্লানটেশন খাতে সরকারী উদ্যোগে কর্মী যাওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। জি টু জি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণের জন্য ডাক-ঢোল পিটিয়ে দু’দফায় সারা দেশ থেকে প্রায় ২২ লাখ কর্মীর নিবন্ধন করা হয়েছিল। কিন্তু জি টু জি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোগে দেশটিতে জনশক্তি রফতানির সুযোগ না থাকায় মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুকর্মীরা দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার পথে পা’ বাড়ায়। ইতিপূর্বে অনেকে সমুদ্রপথে যাত্রা করে অকালে সাগরপথে প্রাণ হারায়। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকেই মালয়েশিয়ায় যেতে না পেরে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে তাদের ভাগ্যে গণকবরে স্থান হয়। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছির। বহু কূটনৈতিক তৎপরতার পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতো শ্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার জি টু জি প্লাস সমঝোতা স্মারকে সই করেন। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে জিটুজি প্লাস চুক্তি স্বাক্ষরের এক দিন পরেই মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত ঘোষণা করে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারী পূর্ব মালয়েশিয়ার কোতাকিনাবালু মোয়ারা তুয়াং আর্মি ক্যাম্পে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো শ্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদী সোর্স কান্ট্রিগুলো থেকে অভিবাসী কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুয়ালালামপুর থেকে একজন প্রবাসী ব্যবসায়ী ইনকিলাবকে জানান, সম্প্রতি সিন্ডিকেটের মূল হোতা জ্যাকেল কোম্পানীর মালিক দাতো নিজাম কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে রুদ্ধদ্বার মিটিং করেছে। এ নিয়ে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সিন্ডিকেটের উচ্চ পর্যায়ের কেউ কেউ এখন কুয়ালালামপুরে বসে মালয়েশিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার নিয়ে কলকাঠি নাড়ছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে কুয়ালালামপুরস্থ হাইকমিশনার শহিদুল ইসলামের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক এসএম আবুল হোসেন গতকাল কুয়ালালামপুর থেকে টেলিফোনে ইনকিলাবকে জানান, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে সকল রিক্রুটিং এজেন্সি সুযোগ পায় এ ব্যাপারে গত ১৬ অক্টোবর কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে লিখিত প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আজ মঙ্গলবার মালয়েশিয়ায় সফররত যুবশ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম রফিককে নিয়ে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনারের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করা হবে। কুয়ালালামপুর থেকে যুবশ্রমিক লীগের সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম রফিক টেলিফোনে ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কারণেই আজ দীর্ঘদিন পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই শ্রমবাজার নিয়ে কোনো সিন্ডিকেট ছিনিমিনি খেলতে না পারে এবং বৈধ যোগ্য রিক্রুটিং এজেন্সিরাই যাতে কম টাকায় মালয়েশিয়া কর্মী পাঠাতে পারে এ বিষয়টি আজ কুয়ালালামপুরস্থ হাইকমিশনার শহিদুল ইসলামের কাছে তুলে ধরবো। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আবারো কেলেংকারির সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হবে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
গতকাল সোমবার কুয়ালালামপুর থেকে বায়রার মালয়েশিয়া জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি’র চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন বে-বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সি’র স্বত্বাধিকারী আলহাজ মোঃ গিয়াস উদ্দিন বাবুল টেলিফোনে ইনকিলাবকে বলেন, অনলাইন প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (কেডিএন) গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভাল দিয়েছে। আরো প্রায় ৪০ হাজার কর্মী নিয়োগের জন্য লেভী জমা দেয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আলহাজ গিয়াস উদ্দিন বাবুল বলেন, মালয়েশিয়ায় প্রচুর বাংলাদেশী কর্মীর চাহিদা রয়েছে। মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশী কর্মীদের নিয়োগ দিতে বেশি আগ্রহী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের দ্বার উন্মুক্ত হবার পথে তার পরেও সিন্ডিকেট চক্র শ্রমবাজার নিয়ে বাধার সৃষ্টি করছে। মালয়েশিয়ায় স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে জনশক্তি রফতানি করতে হলে সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কর্মী প্রেরণের সুযোগ দিতে হবে। এটা সকল রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার ক্ষুণœ করে গুঁটি কয়েক কালো বাজারির হাতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার তুলে দেয়া হলে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীরা প্রতারিত হবার আশংকা রয়েছে। আলহাজ গিয়াস উদ্দিন বাবুল মালয়েশিয়ার ইস্যুকৃত হাজার হাজার অ্যাপ্রুভাল নিয়ে অহেতুক কালক্ষেপণ করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সোর্স কান্ট্রির মর্যাদা লাভ করেছে। একমাত্র বাংলাদেশ বাদে বাকি ১৫টি সোর্স কান্ট্রি থেকেই মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী আমদানি করছে। তিনি আরো বলেন, সিদ্ধান্তহীনতার কারণে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন নতুন কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভালের ফাইল জমা নিচ্ছে না। এতে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু লাখ লাখ কর্মী ও জনশক্তি রফতানিকারকদের মাছে দিন দিন হতাশা বাড়ছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীরা রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে পাসপোর্ট জমা দিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটাচ্ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন ইস্যুকৃত অ্যাপ্রুভাল রিসিভ করে সত্যায়ন দেয়া শুরু করা না হলে উল্লেখিত শ্রমবাজার হাত ছাড়া হতে পারে। মালয়েশিয়ায় স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আলহাজ গিয়াস উদ্দিন বাবুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন