বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। এ বছর বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে ১৩তম অবস্থানে এসেছে। কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায়ও এক ধাপ অবনমন ঘটে ১৪৬ থেকে ১৪৭তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। আর এশিয়ার মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং আফগানিস্তানের নাম এক নম্বরে রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। বৈশ্বিকভাবে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্য ২০২১ এর সূচকে ব্যবহৃত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির ধারণা সূচকে এ বছর বাংলাদেশ ২৬ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক। সূচকে ৪০ স্কোর পেয়ে ৮৫ এবং ২৮ স্কোর পেয়ে ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চ ৮৮ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যৌথভাবে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। সর্বনিম্ন ১১ স্কোর পেয়ে তালিকার শেষে রয়েছে দক্ষিণ সুদান।
ড. ইফতেখার আরও বলেন, গত বছরও বাংলাদেশ একই স্কোর পেয়েছিল। সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। এর আগে বাংলাদেশ ২০২০, ২০১৯ ও ২০১৮ সালে একই স্কোর পেয়েছে।
টিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবারের সূচকে ১৮০টি দেশের গড় স্কোর হল ৪৩। তালিকায় এবার সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফ্রিকার দেশ সাউথ সুদান; তাদের স্কোর ১১। এরপরে রয়েছে যথাক্রমে সিরিয়া, সোমালিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইয়েমেন, উত্তর কেরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও তুর্কমেনিস্তান। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৮৮ স্কোর নিয়ে গতবারের মতই তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। এর পরে রয়েছে ফিনল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ ও জার্মানি। সিপিআই-২০২১ এর তথ্যের উৎস ছিল ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ, যার চলমান তথ্য এই সূচকে ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আটটি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো হলÑ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বার্টেলসম্যান ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ভেরাইটিজ অব ডেমোক্রেসিজ প্রজেক্ট।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সিপিআই তৈরিতে দুর্নীতি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এই তিনটি বিষয়কে মূলমন্ত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের স্কোর খারাপ হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ উদঘাটন করেছে টিআই। সংস্থাটির মতে, বড় মাপের দুর্নীতি অনুসন্ধানে সরকারের ব্যর্থতা এখন বাস্তবতা। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছেÑ রাজনৈতিক অবক্ষয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা; গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিস্ক্রিয়তা এবং দায় এড়ানোর সংস্কৃতি; দেশ পরিচালনা নীতিতে সাধারণ জনগণের স্বার্থের চেয়ে উচ্চবিত্তদের প্রাধান্য দেয়া এবং ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার; কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতে নানা কেলেঙ্কারি; বড় ধরণের দুর্নীতিকে বিচারের আওতায় না আনা এবং রাঘব বোয়ালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে দুদকের অকার্যকর ভূমিকা; আর্থিক ও ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণখেলাপীদের বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং চুক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ; গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের কার্যক্রম সংকুচিত করা; মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা এবং তথ্য, সংবাদ প্রকাশ ও বিরোধীমতের প্রতি অসহনশীলতা। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনের কারণ হিসেবে আইনের শাসনের ঘাটতি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যহারকে উল্লেখ করেছে টিআই।
বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০২১ সালের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার্লিনভিত্তিক সংস্থা টিআই এই বার্ষিক সূচক প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে বাজে অবস্থা কেবল আফগানিস্তানের। ১৬ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভাল থেকে খারাপ) রয়েছে তালিকার ১৭৩ নম্বরে। এ এলাকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভুটান। ৬৮ স্কোর নিয়ে ভুটানের অবস্থান সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ২৫ নম্বরে। এরপর ভারত ও মালদ্বীপ ৮৫ (স্কোর ৪০), শ্রীলঙ্কা ১০২ (স্কোর ৩৭), নেপাল ১১৭ (স্কোর ৩৩), পাকিস্তান ও মিয়ানমার ১৪০তম (স্কোর ২৮) অবস্থানে রয়েছে। ২৬ স্কোরে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানের রয়েছে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বরাবরের মত দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এটা আমাদের জন্য আরও বেশি হতাশাব্যঞ্জক। অন্যদিকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের কথা বিবেচনা করা হলে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে তৃতীয়, বাংলাদেশের পরেই কম্বোডিয়া। এরপর যৌথভাবে আফগানিস্তান এবং উত্তর কোরিয়ার অবস্থান।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুর্নীতি দমনে আমাদের প্রতিষ্ঠান আছে, আইন আছে, রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে শূন্য সহিষ্ণুতা, এটা কেবল বলা হয়নি, নির্বাচনী অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু যাদের ওপর শূন্য সহনশীলতা বাস্তবায়নের দায়িত্ব, তাদের একাংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দুর্নীতির ফলে তারা লাভবান, দুর্নীতি তারা প্রমোট করেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের ‘জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে’ রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা করতে হবে। তিনি বলেন, তাহলেই আমরা ইতিবাচক জায়গায় যেতে পারব। এই সম্ভাবনা আছে, বাংলাদেশ অর্থনীতি অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রগতি আরও আর্থবহ হতে পারত যদি আমরা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন