এদেশে এক সময় মানুষ সনাতন বা হিন্দু ধর্মের অনুসরণ করত। পৃথিবীতে ইসলামের আগমনের পর মাত্র পাঁচ দশকের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে। এ ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টিীয় অষ্টম শতকের আগে-পরে এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছে বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। এখানে যারাই ইসলাম গ্রহণ করেছেন তারা নিজেদেরকে ইসলামের বিধানাবলরি আলোকে ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করেছেন। নিজেদের হিন্দু-ধর্মীয় নাম পরিবর্তন করে ইসলামী নামকরণ এ প্রক্রিয়ারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তবে পূর্ণরূপে তা অনুশীলিত হতে দীর্ঘদিন লেগে যায়। গবেষকদের মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও কিছু মুসলিমের নামে হিন্দুয়ানী নামের অস্তিত্ব পাওয়া যেত। ১৯১১ সালে প্রকাশিত নোয়াখালীর ডিস্ট্রিক গেজেটে উল্লেখ করা হয়, জেলাটির সংখ্যাগরিষ্ট অংশ আদিবাসী উপজাতীয় বংশীয় এবং চাঁদ, পাল,ও দত্ত পদবীধারী (মুসলমারদের)এখনো এ জেলায় দেখা যায়। কিন্তু মুসলিম সংস্কারক কারামত আলী জৈনপুরী রহ. (মৃ.১৮৯৪ খ্রী.) সহ তৎকালীন আলিম-ওলামার প্রচেষ্টায় তা দূরীভূত হয়। পরবর্তীতে অন্য গবেষণায় তা ফুটে উঠে। ১৯৫৬ সাল নাগাদ দেখা যায়, উক্ত জেলার মুসলিমদের মধ্যে উল্লেখিত ধরণের নাম বাস্তবেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর সংস্কারক আলিমদের প্রভাবের কারণে তা আরবী পদবীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
তবে মুসলিমগণ এখানকার স্থানীয় মর্যাদা ও সামাজিক অবন্থার আলোকে শেখ, ভূঞা, খান ইত্যাদি উপাধি গ্রহন করতেন এবং দীর্ঘ দিন নামের সাথে ব্যবহারের ফলে তা তাদের পরিচয় বহনে নামের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়। একটি বিখ্যাত প্রবাদ, যা বাংলা ও উভয় ভারতে ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং হাসিমুখে বলা হয়, যা ইসলামে বৈধ পদবীর সাথে সামাজিক মর্যাদাকে ফুটিয়ে তোলে; ‘প্রথম বছর আমি ছিলাম শেখ, দ্বিতীয় বছর খান ধানের দাম যদি কমে এই বছর, আমি হব সৈয়দ’। এভাবে আরবী নাম ও স্থানীয় উপাধি মিলে মুসলিম পরিচয় সমাজে বিকশিত হয়। যা ইসলামের অনুমোদিত।
ইংরেজ শাসনামলে (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রী.) এ অঞ্চলে মুসলিমগণ দারুণভাবে নিষ্পেষিত হতে থাকে। হিন্দুগণ ইংরেজদের সাথে সখ্যতা তৈরি করে তাদের আনুগত্য করে একদিকে যেমনি নিজেরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে থাকে, অপরদিকে নেপথ্যে থেকে ইংরেজদের মাধ্যমে এবং কখনো কখনো নিজেরাই মুসলিমদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার চালাতে থাকে। এ ধারায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এ অঞ্চলের মুসলিমদেরদের উপর হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় তারা মুসলিমদেরকে তহবন্দের পরিবর্তে ধূতি পরা, সালামের পরিবর্তে আদাব-নমস্কার বলা, নামের আগে শ্রী ব্যবহার, মুসলমানী নাম রাখতে জমিদারের অনুমতি ও খারিজানা প্রদান, দাঁড়ির জন্য ট্যাক্স প্রদান, গরু জবাই করলে হাত কেটে নেয়া ইত্যাদি নানা ধরনের জুলুম-নির্যাতন মুসলিমদের উপর চালাতে থাকে। ফলে অনেক মুসলিম নামের পূর্বে শ্রী ব্যবহার করতে শুরু করে। যার প্রেক্ষিতে গড়ে উঠে ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন।
এ আন্দোলনের ফলে মুসলিমদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। ফলে অনেকে নামের পূবের শ্রী বর্জন করে, আবার অনেকে শ্রী এর পরিবর্তে মুহাম্মদ ব্যবহার করতে শুরু করে। এভাবে নামের শুরুতে মুহাম্মাদ সংযুক্তি ইসলামের ধর্মীয় সংস্কৃতির রূপ ধারণ করে।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যায়ে যেখানে মুসলিমদের মধ্যে হিন্দুয়ানী নামের অস্তিত্বই পাওয়া যেত না, সেখানে বর্তমানে তা অনেকাংশেই অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলছে। মুসলিমগণ আজ পাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির আগ্রাসনে নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলতে বসেছে। মুসলিমগণ হিন্দুদের নাম গ্রহণ করছে। কিন্তু কোন হিন্দু-খ্রীস্টান মুসলিদের নাম গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের মুসলিমগণই প্রথম আগ্রহ সহকারে হিন্দু নাম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের প্রয়াত একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক দুঃখ করে বলেছেন, একাল আর সেকাল, মাত্র ৪০/৫০ বছরের ব্যবধান। তখন মুসলমান মা-বাবারা সন্তানের নাম রাখতেন আল্লাহর নামের সাথে মিলিয়ে অথবা নবী-রাসূলের নামে বা ইসলামের ইতিহাসের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাত স্মরণীয় মনীষীদের নামানুসারে। এমন নাম তারা রাখতেন যে সব নামের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য, গৌরব বা ঐতিহ্য স্ৃিষ্টর সার্থক পরিস্ফুটন ঘটত। কিন্তু সে ধারা আজকাল প্রায়ই রক্ষা করা হচ্ছে না।
যে হিন্দুয়ানী জুলুমের প্রতিবাদে মুসলিমদের নামে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দের সংযুক্তি; বর্তমানে তাদেরই অনুজ হিন্দু বৌদ্দ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মুসলিমদের নামের মুহাম্মাদ শব্দ বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে। ২০০০ সালের ৬ জুন শহীদ মিনার থেকে এ আহবানের সূচনা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের এ আহবানে এদেশের মুসলিম নামধারী কিছু বুদ্ধিজীবীও একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। সাংবাদিক জহুরী তাদেরকে নিজেদের মুসলিম নাম পরিবর্তন করে তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী বাঙ্গালী হবার আহবান জানিয়েছেন। বর্তমানে এ ধারা আরো শক্তিশালী হচ্ছে এবং মুসলিমদের উপর ক্রমান্বয়ে প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে হয়।
মুহাম্মদ শব্দের বানান পূর্ণরূপে আমাদের দেশে সাধরণত দু’ভাবে লেখা হয় মুহাম্মদ ও মোহাম্মদ। কেউ ‘ম’ তে ওকার দিয়ে লেখেন, কেউ হ্রস্ব উকার দিয়ে লেখেন। দু’ নিয়মেই চলছে। যদিও ‘মু’ দিয়ে লেখাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কিন্তু একশ্রেণির লোক ‘মোঃ’ সংক্ষিপ্তকারে লেখেন। অথচ তারা তাদের অন্যান্য শব্দ সংক্ষেপ করে লেখার চিন্তা করেন না। খন্ডিত নাম অর্থহীন হয়ে পড়ে। ‘মোঃ’ এর কোন অর্থ নেই,
অর্থবোধক শুধু মোহাম্মাদ শব্দ। আবার অনেকে মু., মো:, মোহাং ইংরেজীতে গ., গফ., গড়যফ ইত্যাদি লেখেন। এরূপ শব্দ একটি অর্থহীন শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব এটিকে সংক্ষিপ্তকরণ, এ শব্দটির প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা প্রদর্শন ব্যতীত আর কিছুই নয়। যা নিঃসন্দেহে নবী সা. এর প্রতি বেয়াদবী ও গুনাহের কাজ।
প্রচলিত মুহাম্মদ শব্দটি শুদ্ধ উচ্চারণ মুহাম্মাদ হওয়া উচিত। বাংলা ভাষায় দীর্ঘ দিন মোহাম্মদও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন