‘আজ দুজনার দুটি পথ/ ওগো, দুটি দিকে গেছে বেঁকে’। পুরনো দিনের এই গানের মতোই রাজধানী ঢাকা শহরে ঘর-সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। সন্তানদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে বাবা-মা নিজেদের মতভেদকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন। পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, উচ্চাবিলাসী, মতভেদসহ নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে গেছে।
অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় করোনাভাইরাসের এই মহামারি সময়ে ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটছে। দুই সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদনের যে চিত্র দেখা যায় তাতে প্রতিমাসে গড়ে এক হাজার ৪২টির বেশি আবেদন জমা পড়ে। এই হিসেবে দেখা যায় প্রতিদিন গড়ে ৩৫টি তালাকনামা জমা পড়ছে। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনে প্রতিমাসে অস্বাভাবিক হারে তালাকের আবেদন জমা পড়ছে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বিগত ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা ১৭ শতাংশ বেড়েছে। পরবর্তীতে প্রতিবছর এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। তালাকের এই চিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখা যায় স্বামীর চেয়ে স্ত্রীরাই বেশি ঘর-সংসার ভাঙার পক্ষে।
জানতে চাইলে সমাজ বিজ্ঞানী ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, উচ্চাবিলাসী মনোভাবের করণে এখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে দুইজনের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নেয়। এতে করে তালাকের মতো ঘটনা ঘটে।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, রাজধানীতে দিন দিন বেড়েই চলেছে তালাকের ঘটনা। এতে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। ভেঙে যাচ্ছে সংসার ও পারিবারিক বন্ধন। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন। গত বছর বিগত বছরের তুলনায় তালাকের ঘটনা ঘটেছে বেশি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের বরাবর তালাকের আবেদনের সংখ্যাও বাড়ছে। বছরে যে পরিমাণ তালাকের আবেদন করা হয় তার গড়ে ৭০ শতাংশই স্ত্রীদের। স্বামীদের আবেদন কম।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসসিসিতে তালাকের আবেদন করেছেন ৬ হাজার ৩৪৫ জন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪২৮টি আবেদন করেছেন নারী বা স্ত্রীরা। এক হাজার ৯১৭টি আবেদন স্বামীদের। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মোট তালাকের আবেদন করা হয়েছে ৭ হাজার ২৪৬টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫২০, ফেব্রুয়ারিতে ৫২৫, মার্চে ৬৫৫, এপ্রিলে ৬০২, মে ৩৬২, জুন ৮৬৬, জুলাই ২৯৪, আগস্ট ৭১২, সেপ্টেম্বর ৮১৪, অক্টোবর ৫৬১, নভেম্বর ৭৫৫ এবং ডিসেম্বরে ৫৮০টি আবেদন করা হয়েছে। স্ত্রী বা নারীরা করেছেন মোট ৫ হাজার ১৮৩টি আবেদন। স্বামীরা করেছেন মোট ২ হাজার ৬৩টি আবেদন। আর মোট আবেদনের সবচেয়ে বেশি আবেদন করা হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে ৮১৪টি। সবচেয়ে কম আবেদন করা হয় জুলাই মাসে ২৯৪টি। এর অধিকাংশ আবেদনই নারীদের বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের।
গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় তালাকের প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যে শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা ১৭ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
তালাকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আগের চেয়ে নারীরা স্বাবলম্বী, স্বাধীন মনোভাব, নারীদের উচ্চ বেতনে চাকরি, আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা, নির্যাতন সহ্য না করা এবং প্রতিবাদ করার মনোভাবের কারণে তালাকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে। কোন কোন সংসারে সন্তান থাকা অবস্থায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাকের ঘটনা ঘটে। ওই সংসারের সন্তানটি শিশু অবস্থায়ই অভিভাবক শূন্য হয়ে পরে। এতে করে সে প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠবে। পরবর্তীতে অপরাধী হয়ে সমাজে বেড়ে উঠার আশঙ্কা থেকে যায়।
ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে করোনার কারণের তৈরি হওয়া মানসিক, আর্থিকসহ নানামুখী চাপের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন এবং যোগাযোগ কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারায়ও পরিবর্তন ঘটছে অতিদ্রুত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ করায় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। ঢাকায় গত এক দশকে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিচ্ছেদের বেশি আবেদন করছেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীরা।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ ও জীবনযাপন যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তখন মধুর সম্পর্ক তালাকের মাধ্যমে ছিন্ন করা হয়। ন্যায়সঙ্গত কারণে তালাক ইসলামে বৈধ। তবে এটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ। কিন্তু শিক্ষিত ও অভিজাত পরিবারে তালাকের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ও পরিবারগুলোতে তালাক এখন সাধারণ ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ২০২১ সলের হিসেব অনুযায়ী দিনে গড়ে ৩৭টি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। এর মধ্যে গড়ে ৭০ শতাংশ আবেদন করছেন নারীরা। তালাকের আবেদনে সমঝোতা হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম। যতোগুলো তালাকের ঘটনা ঘটছে তার কারণগুলো প্রায় একই। যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, পুরুষত্বহীনতাসহ বিভিন্ন কারণ। অন্যদিকে বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামীরা।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, তালাকের নোটিশ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত হয়। তারপর সেখান থেকে তালাকের আবেদন স্বামী এবং স্ত্রী সিটি করপোরেশনের কোন অঞ্চলে বাস করেন, সেই অনুযায়ী ওই অঞ্চলে পাঠানো হয়। পরে আবেদনকারী ও বিবাদী উভয়পক্ষকেই আপসের নোটিশ পাঠান সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট)। দুই পক্ষের মধ্যে আপস না হলে সিটি করপোরেশনের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস বা প্রত্যাহার আবেদন না করলেও তালাক কার্যকর হয়ে যায়।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসিতে ১২ হাজার ৫১৩টি তালাকের আবেদন করা হয়েছে। অর্থাৎ মাসে গড়ে এক হাজার ৪২টির বেশি, যা দিনে গড়ে ৩৫টি, ঘণ্টায় একটিরও বেশি। ২০১৯ সালে ডিএনসিসিতে তালাকের আবেদন করা হয়েছে ছয় হাজার ১৬৮টি, ডিএসসিসিতে ৬ হাজার ৩৬০টি। এভাবে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মানসিক চাপসহ সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
ডিএসসিসি মেয়র বরাবর আবেদন করেন কলাবাগান এলাকার ওয়াফা অনোয়ার নামের এক নারী। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কসহ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি তালাকের আবেদন করেন। স্বামী মিজানুর রহমানের বিপক্ষে তিনি গত ১৩ জানুয়ারি আবেদনটি করেন।
সায়মা আফরিন লাবন্য থাকেন দক্ষিণ বনশ্রী এলাকায় ডিএসসিসির মেয়র বরাবর তালাকের আবেদন করেছেন গত ১৫ জানুয়ারি। তিনিও স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়াসহ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।
রিনা আক্তার থাকেন যাত্রাবাড়ী এলাকার রায়েরবাগ। গত ১৮ জানুয়ারি ডিএসসিসি মেয়র বরাবর তালাকের আবেদন করেছেন একই কারণ দেখিয়ে। খিলগাঁও মেরাদিয়া এলাকার আকলিমা ও গোড়ান এলাকার আছিয়া বেগম তালাকের আবেদন করেছেন স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়া ও পরনারীর সাথে সম্পর্কের কারণে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তালাকের আবেদন করা এক নারী জানান, চার বছরের মেয়ে রয়েছে তার সংসারে। স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। কিন্তু সুখের সংসার রেখে তার স্বামী অফিসের এক কলিগের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। বার বার বারণ করার পরও ওই সম্পর্ক ছিন্ন করছেন না। বরং ওই নারীর সাথে সম্পর্ক বাদ দিতে বললে শারিরীকভাবে নির্যাতন করেন। এজন্য তিনি তালাকের আবেদন করেছেন।###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন