বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মাসিক বেতনে নকল জেলে আসল যাচ্ছিলো বিদেশে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ এএম

রাজধানীর কদমতলীতে টিটু নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয় ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর। এর পর হত্যা মামলার প্রধান আসামি সোহাগ ওরফে বড় সোহাগকে ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৪ সালের ১৬ মে জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান সে । ২০১৭ সালে আদালতের রায়ে সোহাগ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হন পলাতক অবস্থায়। নিজেকে বাঁচাতে এবং দেশ থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার কাহিনির মতো অন্যজনকে আসামি হিসেবে আদালতে পাঠান সোহাগ নামে। এজন্য চুক্তি হয় মাসিক ৫ হাজার টাকা। আদালত হোসেনকে ‘সোহাগ ভেবে’ জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। অন্যদিকে আসল আসামি সোহাগ দেশ থেকে পালিয়ে দুবাই যাবার উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতারণার আশ্রয় নেন। নিজের পিতার নাম পরিবর্তন করে বাগিয়ে নেন এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট । তবে বিষয়টি টের পাবার পর থেকে আসল সোহাগকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে আসছিল র‌্যাব। পরে গত শনিবার টিকা দিতে এসে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল হাসপাতালের সামনে থেকে র‌্যাব-১০ এর হাতে গ্রেফতার হন ‘আসল’ সোহাগ। গতকাল রোববার কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর এ জালিয়াতির তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান।

তিনি বলেন, গত ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর কদমতলী থানার আউটার সার্কুলার রোডে হুমায়ুন কবির ওরফে টিটু নামে একজন গুলিতে আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। ওই ঘটনায় তার পরিবার কদমতলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। তাতে আসামি করা হয় সোহাগ ওরফে বড় সোহাগসহ (৩৪) আরও তিন থেকে চারজনকে। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর গ্রেফতার হয়ে জেলে যান সোহাগ। কারাগার থেকে ২০১৪ সালের ১৬ মে জামিনে বেরিয়ে পলাতক জীবনযাপন শুরু করেন তিনি। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মামলার এক নম্বর আসামি সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ পলাতক থাকতেই আদালত রায় দেন। রায়ে সোহাগ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। আদালতের রায়ের পর সোহাগ নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজতে থাকেন। পরিকল্পনা করেন আসামি পরিবর্তনের মাধ্যমে জামিন পাওয়ার। বাল্যকাল থেকে প্রকৃত সোহাগের সঙ্গে সখ্যতা ছিল ফুফাতো ভাই মো. হোসেনের (৩৫)। জামিন না পেলেও অন্তত নিজে আড়ালেই থাকবেন, এমন পরিকল্পনায় সোহাগ মাসিক পাঁচ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলে ফুফাতো ভাই হোসেনের সঙ্গে চুক্তি করেন। পাশাপাশি প্রকৃত সোহাগ ‘নকল সোহাগ’ অর্থাৎ হোসেনকে জেল হাজতে পাঠানোর আগে আশ্বস্ত করেন যে, দুই-তিন মাসের মধ্যে বের করে নিয়ে আসবেন।
তিনি আরো বলেন, চুক্তি অনুযায়ী মাদকাসক্ত হোসেন নকল সোহাগ সেজে আত্মসমর্পণ করে আদালতে জামিন আবেদন করেন। মো. হোসেনের বাবার নাম মৃত হাসান উদ্দিন। আর আসল সোহাগের বাবার নাম গিয়াস উদ্দিন। আদালত আসামি বদল বা নকল সোহাগকে চিনতে না পারলেও জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। এরপর থেকেই কারাগারে থাকেন নকল সোহাগ। আর আসল সোহাগ রয়ে যান আড়ালেই।
র‌্যাব জানায়, নকল সোহাগের জেল খাটার বিষয়টি সর্বপ্রথম আদালতের সামনে আনেন জনৈক সাংবাদিক। আদালত তা আমলে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চান। প্রতিবেদনে ২০১০ সালে প্রথম গ্রেফতার হওয়া সোহাগের তথ্য ও শনাক্তের বিবরণীর সঙ্গে কারাগারে থাকা নকল সোহাগের অমিল পেলে তা আদালতকে জানানো হয়। আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের রিপোর্টেও নকল সোহাগের জেল খাটার সত্যতা মেলে।
অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, কারাগার ও পুলিশের প্রতিবেদনে নকল সোহাগের জেল খাটার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর বিশেষ দায়রা আদালত ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ প্রকৃত সোহাগের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন, যার একটি অনুলিপি পান র‌্যাব-১০ অধিনায়ক। এরপর ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে র‌্যাব-১০ এর অপারেশন টিম ও র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দার একটি টিম আসল সোহাগের খোঁজে তদন্ত ও অভিযান শুরু করে। দীর্ঘ তথ্যানুসন্ধান ও গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-১০ এর সদর কোম্পানির অপারেশন টিম র‌্যাব সদরদফতরের গোয়েন্দা শাখার সহযোগিতায় জানতে পারে দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য টিকার ডোজ পূরণ ও টিকা কার্ড সংগ্রহ করতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল তথা মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় আসবেন। ওই তথ্যের ভিত্তিতে টিটু হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি সোহাগ ওরফে বড় সোহাগকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করে।
তিনি বলেন, প্রকৃত বা আসল সোহাগ যাবজ্জীবন কারাভোগের বিষয়টি জানার পর নিজের বাঁচার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি সুকৌশলে দেশত্যাগের চেষ্টা শুরু করেন। দেশ ছেড়ে পালাতে এনআইডি কার্ড সংশোধন করে বাবার নাম গিয়াস উদ্দিনও ওরফে কাঙ্গালের জায়গায় মামা শাহআলমের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই এনআইডি কার্ড ব্যবহারে ১০ হাজার টাকা খরচ করে দালালের সহযোগিতায় পাসপোর্ট তৈরি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সংগ্রহ করেন। মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে ভিসা করতে তিনি খরচ করেন আরও ৫০ হাজার টাকা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ ছাড়ার প্রায় সব প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করেন হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সোহাগ। তবে করোনা পরিস্থিতি ফের খারাপ হওয়ায় দেশত্যাগে করোনার টিকাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এটিই কাল হয় সোহাগের।
এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, মামলার বিবরণ অনুযায়ী আসল সোহাগ অটোচালক হলেও তিনি মূলত পেশাদার অপরাধী। জিজ্ঞাসাবাদে ও তদন্তে জানা গেছে, প্রকৃত আসামি সোহাগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় দুটি হত্যা মামলা, দুটি অস্ত্র মামলা ও ছয়টি মাদক মামলাসহ ১০টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে তিনি টিটু হত্যাসহ দুটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।
এনআইডির তথ্য সংশোধন ও পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-১০ অধিনায়ক বলেন, আমরা প্রথমত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসল অপরাধীতে গ্রেফতার করলাম। এখন ওই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা বিষয়টি দেখভাল করবেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তবে র‌্যাব সদরদফতর যদি মনে করে এ চাঞ্চল্যকর মামলাটি র‌্যাবের তদন্তাধীন বিষয়, তাহলে আবেদন করে মামলার তদন্তভার চাওয়া হবে।
কীভাবে আসল সোহাগের পরিবর্তে নকল সোহাগ আদালতে জামিন চাইলেন এবং কারাগারে গেলেন, এসবের পেছনে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আইনজীবীর দায় খোঁজা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালতে আসামি বদলে ফেলার বিষয়টি ধরতে পারা কঠিন বিষয়। তবে এক্ষেত্রে কারাগার অবশ্যই পারে। কারণ তাদের কাছে ডাটাবেজ আছে এবং আসামি শনাক্তকরণের বিবরণীও সংরক্ষিত আছে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত আসামির আইনজীবী জেনেই নকল সোহাগের জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন। তার দায় তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশ্চয় খুঁজবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন