প্রকৃতির বহুমাত্রিক সৌন্দর্য স্বপ্ন ও কল্পনাকেও হার মানায়। ইট-পাথরের তৈরি শহরে যান্ত্রিক শব্দ ছাড়িয়ে খানিকটা দূরের দিকে দৃষ্টি দিলে সবুজতায় বাস্তবেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বিশেষ করে বিস্তীর্ণ এলাকায় পানিতে ছোট ছোট ঢেউ এবং চারপাশের সবুজ। হাওর অঞ্চলে এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বার বার কাছে ডাকে।
হাকালুকি তেমনি একটি হাওর যেটি নামেই দেশের সবাই চিনেন। অন্যতম মাদার ফিশারিজ এই হাকালুকি হাওর। মানুষের সৃষ্ট নয়; প্রকৃতির অফুরন্ত দান হাকালুকি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অপরূপ সৌন্দর্য আজ অবহেলিত। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা সিলেট বিভাগের চোখ জুড়ানো হাকালুকি হাওর দেখতে আসেন।
হাকালুকির পানির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী। এই পানি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। এইসময় পানির গভীরতা হয় সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৬ মিটার।
হাকালুকি হাওরকে পর্যটনবান্ধব করতে শত কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থানীয় এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে স্বপ্ন নয়, সত্যি হয়ে তা অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। দেশ সমৃদ্ধ হবে হাওর অঞ্চলের অর্থনীতিতে। হাকালুকি হাওর পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি অপার সম্ভাবনাময় সুযোগ তৈরি হবে।
হাকালুকি হাওর হচ্ছে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এটি সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫টি উপজেলায় নিয়ে বিস্তৃত। এখানে ২৩৮টি বিল রয়েছে। বিলগুলোতে সারাবছর পানি থাকে। উল্লেখযোগ্য বিল হচ্ছে, চাতলা, চৌকিয়া, ডুলা, পিংলারকোণা, ফুটি, তুরাল ও তেকুনি বিল। এছাড়াও ছোট-বড় ১০টি নদী নিয়ে গঠিত এই হাকালুকি হাওর।
বর্ষাকালে হাকালুকির আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়। জীববিজ্ঞানীদের মতে, হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ বিলুপ্ত প্রায়। প্রতিবছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। শীত মৌসুমে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন।
বিলের পানির মাঝে ও চারপাশে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের পানির প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের পানিতে সূর্যের প্রতিচ্ছবি এক মনোরম দৃশ্য তৈরি করে।
শীত মৌসুমে হাওরের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখির উপস্থিতি ও তাদের হরেক রকমের শব্দ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অতিথি পাখি হাকালুকি হাওরে শীতকাল কাটিয়ে ফিরে যায় ফেলে আসা ঠিকানায়। আবার কোনো কোনো অতিথি পাখি হাকালুকিতেই গড়েছে তাদের আবাসস্থল। শীকাল মানেই হাকালুকি হাওর পরিণত হয় দেশিয় ও অতিথি পাখির মিলনমেলায়।
এছাড়া অগনিত মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প হচ্ছে এই হাওর। প্রতিদিন শত শত মানুষ হাওরকে ঘিরে নির্বাহ করেন তাদের জীবন-জীবিকা। হাওরের সাথে তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা মিশে আছে। শুনতে অবাক লাগলেও দেশের বৃহত্তম মিঠাপানির এই জলাভূমি পুরো এশিয়ার মধ্যেই অন্যতম জলজ নিদর্শন। ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে খ্যাত হাকালুকি হাওর বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দশনার্থী পর্যটকরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিডবোটের মাধ্যমে ঘুরে উপভোগ করেন হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য।
পর্যটকদের সুবিধার্থে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার হাকালুকি হাওরের ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্টে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব। গত ১৪ জানুয়ারি হাকালুকি হাওরে ফেঞ্চুগঞ্জের জিরো পয়েন্ট ও হিজলবন পরিদর্শনে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের এমন কথাই বলেছেন।
তিনি আরও জানান, প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে, হাকালুকি হাওর এলাকায় বোরো ফসল রক্ষার্থে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, পর্যটক আকর্ষণে ঢাকার হাতিরঝিলের মতো নয়নাভিরাম আর্চ ব্রীজ নির্মাণ, ফেঞ্চুগঞ্জের জিরো পয়েন্ট এলাকায় বর্ষা ও শীত মৌসুমে ঘুরতে আসা পর্যটকদের বসার জন্য বেঞ্চ, শিশুদের জন্য থাকবে দোলনা ও বিভিন্ন খেলার সামগ্রী।
হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আমরা আশা করছি এই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পর্যটকদের আরও আকর্ষণ করবে হাওরের নয়নাভিরাম চিত্র। শত কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্থানীয় জিরো পয়েন্টের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মুহিব উদ্দিন বাদল। তিনি বলেন, প্রতিবছর সর্বনাশ হয় ফসলের। অকাল বন্যায় ফসলহানী ঘটে। একটি বেড়িবাঁধ এখানকার মানুষের প্রাণের দাবি। বেড়িবাঁধ হলে ফসল রক্ষা হবে। সেই সাথে গড়ে উঠবে স্থানীয় অর্থনীতির ভিত্তি। এমনিতেই দর্শনার্থী পর্যটকের ভিড় থাকে। পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো গড়ে উঠলে এ অঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থানসহ নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়বে।
সিলেট চেম্বারের সভাপতি ও এফবিসিসিআই পরিচালক তাহমিন আহমদ বলেন, বৃহত্তর সিলেটে পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এর মধ্যে হাকালুকি হ্ওারের প্রাচুর্য বলা বাহুল্য। সৌন্দর্য উপভোগে দর্শনার্থীরা নিজ প্রচেষ্টায় হাওরে আসেন। যদি পরিকল্পিতভাবে হাকালুকিকে সাজানো যায় তাহলে কৃষি বিপ্লবসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, ইকোটুরিজ্যম শিল্প বিকাশে এক অসাধারণ নজির স্থাপন করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন