শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

গুলিস্তান ফুটপাতে ‘টাকার খনি’

প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাত যেনো টাকার খনি। প্রতিদিন এই ফুটপাত থেকে টাকা তোলা হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই টাকা যায় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, মাস্তান, প্রভাবশালী ও লাইনম্যানদের পকেটে। এ কারণে ফুটপাত উচ্ছেদ করতে গেলেই বাধা আসে। অস্ত্রহাতে ছুটে আসে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাঈদ ও মামুন সরদার এবং প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহমেদ গুলিস্তান এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে গেলে হকাররা বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ ও হকারদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এসময় অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোঁড়ে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন ও ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। অস্ত্রহাতে এই দুই নেতার ছবি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। গত সোমবার রাতে এই দুজনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় ‘হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ। বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, মামলার আগেই সাব্বির হোসেন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
গুলিস্তানে ফুটপাত আছে ৩০টি। এসব ফুটপাতে হকারদের দোকান আছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০২ জন সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত। বাকিরা তালিকাভুক্ত নয় এবং বেশিরভাগই রাস্তা দখল করে দোকান বসায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সাড়ে ৪ হাজার দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন এই চাঁদার পরিমাণ কমপক্ষে ৬ লাখ টাকা। মাস শেষে যা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গুলিস্তানের ৩০টি ফুটপাতে চাঁদা তোলার জন্য ৩০ জন লাইনম্যান আছে। প্রতিটি লাইনম্যানের আবার একজন করে সহকারী আছে। লাইনম্যান ও তাদের সহকারী মিলে ৬০ জনের আবার একজন নেতা, একজন ক্যাশিয়ার ও একজন সহকারী আছে। ৬০ জনের এই নেতার নাম বাবুল। ক্যাশিয়ার দুলাল এবং তাদের সহকারীর নাম আমীন। ৬৩ জনের এই সিন্ডিকেটকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে সরকার সমর্থক একটি সংগঠনও বানানো হয়েছে। যার সভাপতি আবুল হাশেম কবীর। ফুটপাত উচ্ছেদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় কিছুদিন আগেও এই কবীরের নেতৃত্বে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে গুলিস্তানে।
জানা গেছে, গুলিস্তানের ফুটপাতের প্রতিটি দোকান থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তোলা হয়। যারা সরাসরি এই চাঁদা তোলে তারা সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাইনম্যান নামধারী এসব চাঁদাবাজদের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ। এ কারণে তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। হকাররা তাদের কাছে জিম্মি। হকারদের ভাষায়, কথায় কথায় এরা লাঠিপেটা করে, অপমান করে, মালামাল কেড়ে নেয়।
অনুসন্ধানে গুলিস্তানের লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের নাম জানা গেছে। এরা নিজ নিজ দখলে থাকা ফুটপাত থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তোলে। এরা হলো, আমীর হোসেন, ভোলা, কানা সিরাজ, লম্বা হারুন, হারুনের শ্যালক দেলোয়ার, খোরশেদ, হাসান, হিন্দু বাবুল, রব, সুলতান, লিপু, মনির, তরিক আলী, আখতার, জাহাঙ্গীর, কালা নবী, সর্দার ছালাম, শহীদ, দাড়িওয়ালা সালাম, আলী মিয়া, কাদের, খলিল, কোটন, জাহাঙ্গীর, নসু, তমিজ উদ্দিন, বাবুল ভূঁইয়া, সাজু, কবির হোসেন, ঘাউরা বাবুল ও বিমল। হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে এরা তৎপর হয়ে ওঠে। সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এমনকি উচ্ছেদ অভিযান প- করার জন্য তারা ‘মাস্তান’ বাহিনীও ঠিক করে রাখে। এজন্য এরা লাখ লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করে না। আলাপকালে একজন লাইনম্যান জানান, ফুটপাতে কেউ ইচ্ছা করলেই চাঁদাবাজি করতে পারে না। এজন্য নেতার অনুমতি লাগে। পেছনে ‘লোক’ লাগে। তাদের পেছনেও সরকার দলীয় ‘লোক’ রয়েছে। ফুটপাতের চাঁদার টাকার ভাগ ওই সব নেতাও পায়। তারাই পেছন থেকে লাইনম্যানদের শক্তি জোগায়। এই শক্তির বলেই চলে লাইনম্যানরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হকার বলেন, পুলিশ লাইনম্যানদের কথায় চলে। লাইনম্যানরা চাঁদার টাকা নির্ধারণ করে। সেই টাকা দিতে দেরি হলে বা কেউ গড়িমসি করলে পুলিশ এসে সেই হকারকে মারধর করে। দোকান ভেঙ্গে দেয়। মালামাল নিয়ে যায়। এ কারণে লাইনম্যানদের কথার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের বিপরীতের এক হকার জানান, ফুটপাতে দোকান বসানোর জন্য প্রতিদিন ১০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। দোকান চলুক আর না চলুক প্রতিদিনের চাঁদা প্রতিদিন দিতে হয়। না দিলে লাইনম্যানরা ওই স্থানে আরেকজনকে বসিয়ে দেয়। মনির হোসেন নামে এক হকার বলেন, মাঝে-মধ্যে সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযান চালালেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা আবার আগের মতো হয়ে যায়। অভিযানের সময় চাঁদাবাজচক্র আশেপাশেই অবস্থান করে। অভিযান বন্ধ হলে তারা আবার দোকান খুলতে বলে। পুলিশ তখন দূরে সরে যায়, দেখেও না দেখার ভান করে। লাইনম্যানরা সবাই সরকারদলীয় নেতার মদদপুষ্ট জানিয়ে ওই হকার বলেন, এদের পেছনের সবাই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগসহ সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা। গত বৃহস্পতিবার গুলিস্তানের হকার উচ্ছেদের পর ফুটপাত আবারও দখল হয়ে গেছে। এর নেপথ্যেও প্রভাবশালী ওই সব নেতারাই বলে জানা গেছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন