শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

করোনা মহামারিকালে ইসলামের দৃষ্টিতে সংক্রামক রোগ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:১৪ এএম

মহামারির ইতিহাস মানব সভ্যতার মতোই প্রাচীন। বিভিন্ন সময় সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনও আবার বিশ্বব্যাপী। এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে পরিচ্ছন্ন থাকতে এবং জনসমাগম এড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, তাই এটি সবাই পালন করছে। কিন্তু জনসমাগম এড়ানোর ব্যাপারে অনেকেই অপারগ। তাই ইচ্ছা থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা পরিহার করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে বলছে, ইসলামে সংক্রামক বলতে কোনো রোগ নেই। ইসলাম ছোঁয়াচে রোগে বিশ্বাস করে না। ফলে ব্যাপারটি নিয়ে ইসলাম ও বিজ্ঞানের আলোকে আলোচনা করা সময়ের দাবি মনে করছি।যাঁরা বলেন ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই, তাঁরা সাধারণত রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিস সামনে রেখে এই কথা বলে থাকেন। হাদিসটি হলো, রাসুল (সা.) বলেছেন, রোগের কোনো সংক্রমণ নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোনো অশুভ নেই। কুষ্ঠরোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো। (বুখারি, হাদিস : ৫৭০৭)এই হাদিস সামনে রেখে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই। এগুলো কুফরি চিন্তাধারা। অথচ বিজ্ঞান বলছে, ছোঁয়াচে রোগ আছে। মানুষ এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাহলে ইসলাম ও বিজ্ঞান কি এ বিষয়ে সাংঘর্ষিক হয়ে গেল? এ বিষয়ে জানতে আমাদের প্রথমে জানতে হবে সংক্রামক রোগ বা ছোঁয়াচে রোগ কী।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সংক্রামক রোগ : এ বিষয়ে পরমাণুবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক জাকিয়া বেগম তাঁর একটি কলামে লেখেন, আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব বাস করে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি শরীরের জন্য বেশ উপকারী, কোনোটি উপকারী না হলেও ক্ষতিকারক নয়, কোনোটি আবার বিশেষ কোনো অবস্থায় বা কোনো বিশেষ কারণে শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে এবং মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত রোগগুলোকেই সংক্রামক রোগ বলা হয়।অনুপ্রবেশকৃত এ ধরনের সংক্রামককে যখন শরীরের রোগ-প্রতিরোধক তন্ত্র বিতাড়ন করার চেষ্টা করতে থাকে তখনই এর ফলে জ্বর, মাথা ব্যথা, র‌্যাশ বা অসুস্থতার বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।...সংক্রামক রোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয় মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করতে পারে।প্রত্যক্ষ মাধ্যম মানুষ থেকে মানুষে। এ ক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তির সান্নিধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্য কোনো জীবাণু সরাসরি সুস্থ মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করে থাকে। সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, স্পর্শ বা চুমুর মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারে।জীবজন্তু থেকে মানুষে : সংক্রমিত কোনো জন্তু, এমনকি পোষা কোনো প্রাণীর কামড় অথবা আঁচড় থেকে এ রোগ বিস্তার লাভ করে থাকে (জুনোটিক)।
পোষা জন্তুর মলমূত্র পরিষ্কার করতে গিয়েও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।মা থেকে নবজাতকে : গর্ভবতী মায়ের থেকে নবজাতক আক্রান্ত হতে পারে। কখনো গর্ভফুলের মাধ্যমে, কখনো বা প্রসবের সময় জরায়ুর মুখ থেকে জীবাণু নবজাতকের শরীরে প্রবেশ করার ঝুঁকি থাকে।পরোক্ষ মাধ্যমে : কোনো কোনো রোগের জীবাণু দূষিত খাদ্য বা পানির মাধ্যমে অথবা দূষিত বাতাস বা পরিবেশের দূষিত কোনো মাধ্যমের সাহায্যে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। কোনো কোনো জীবাণু জীবন্ত কোনো মাধ্যম ছাড়া জড় পদার্থকে নির্ভর করে বেশ কিছু সময় টিকে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে জীবাণুগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করার আশঙ্কা দেখা দেয়। যেমন—ফ্লুতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস সুস্থ কেউ ব্যবহার করলে সে সংক্রমিত হয়ে উঠতে পারে।মানুষ সাধারণভাবে যেসব অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে—ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস এবং পরজীবী (প্যারাসাইট)।
ইসলামের দৃষ্টিতে সংক্রামক রোগ : ইসলামের দৃষ্টিতে শরীরে রোগ-ব্যাধি দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ, আবার তাঁর ইচ্ছায়ই আরোগ্য লাভ করা যায়। কোনো বস্তু বা ব্যক্তি কাউকে রোগাক্রান্ত করতে পারে না, আবার তা থেকে সুস্থ করে তুলতেও পারে না। আমাদের জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা-অসুস্থতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই। তাই মহান আল্লাহ বিভিন্ন রোগ যেমন সৃষ্টি করেছেন, তার প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন, বান্দা কখনো কখনো তাঁর দয়ায় সেই প্রতিষেধক জানতে পারে, আবার কখনো কখনো জানতে পারে না।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৭৮)। একমাত্র আল্লাহই রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য দান করেন। এই কথার ওপর ঈমান না রাখলে সে মুমিন থাকবে না। তবে এর মানে এই নয় যে কেউ রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা গ্রহণ করা যাবে না। বরং রাসুল (সা.) উম্মতকে অসুস্থ হলে অবশ্যই চিকিৎসা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলাই রোগ ও ওষুধ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক রোগের চিকিৎসাও তিনি সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৬৪।
কোনো রোগ আপন শক্তিতে মানুষকে আক্রান্ত কিংবা হত্যা করার শক্তি রাখে না, এটাও সত্য। তাই বলে কোনো এলাকায় রোগ-ব্যাধি দেখা দিলে সেখানে অসতর্ক অবস্থায় চলাফেরার অনুমতিও ইসলাম দেয়নি। কারণ মহান আল্লাহ যেমন রোগ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি রোগাক্রান্ত হওয়ার বিভিন্ন মাধ্যমও সৃষ্টি করেছেন। এবং তা থেকেমুক্ত থাকার জন্য তাঁর প্রেরিত রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে মানুষকে দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। কোনো এলাকায় মহামারি কিংবা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তিনি সেখানে যাতায়াত করতেও বারণ করেছেন। একবার সাআদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) উসামা ইবনে জায়েদ (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে প্লেগ সম্পর্কে কী শুনেছেন? উসামা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, প্লেগ একটি আজাব, যা বনি ইসরাঈলের এক সম্প্রদায়ের ওপর পতিত হয়েছিল অথবা তোমাদের আগে যারা ছিল। তোমরা যখন কোনো স্থানে প্লেগের ছড়াছড়ি শুনতে পাও, তখন তোমরা সেখানে যেয়ো না। আর যখন প্লেগ এমন জায়গায় দেখা দেয়, যেখানে তুমি অবস্থান করছ, তখন সেই স্থান থেকে পালানোর লক্ষ্যে বের হয়ো না। (বুখারি, হাদিস : ৩৪৭৩)।
এই হাদিস দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে কোথাও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আমাদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ওপরে সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই বলতে যে হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রোগের কোনো নিজস্ব শক্তি নেই মানুষকে আক্রান্ত করার। তবে যেহেতু রাসুল (সা.) এ সময় সতর্ক থাকতে বলেছেন, তাই কোথাও এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আমাদের অবশ্যই যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ কারণেই সেই হাদিসের শেষ ভাগে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কুষ্ঠরোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’ আল্লাহর হুকুম ছাড়া যদি কোনো জিনিস মানুষের ক্ষতি করতে পারত, তাহলে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নমরুদের আগুন গ্রাস করতে পারত। কিন্তু মহান আল্লাহর হুকুমে আগুন তাঁর কিছুই করতে পারেনি। কুষ্ঠরোগীর কাছে কেউ গেলেই যে সে সংক্রমিত হবে, ব্যাপারটি এমন নয়। তবে যেহেতু মহান আল্লাহ রোগটিকে সংক্রামক গুণ দিয়েছেন, তাই তা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুল (সা.) ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই বললে জনৈক বেদুঈন আরব জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! তাহলে সেই উটপালের অবস্থা কী, যা কোনো বালুকাময় প্রান্তরে অবস্থান করে এবং সুস্থ-সবল থাকে? অতঃপর সেখানে কোনো খুজলি-পাঁচড়ায় আক্রান্ত উট তাদের মধ্যে এসে পড়ে এবং সবগুলোকে ওই রোগে আক্রান্ত করে ছাড়ে? (এর জবাবে) তিনি বললেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে রোগাক্রান্ত করেছিল? যে মহান আল্লাহ প্রথম উটটিকে রোগাক্রান্ত করেছিলেন, তিনিই তো অন্যান্য উটকে আক্রান্ত করেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৫৭৪২)।
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অসুস্থ উটগুলোর মালিক তার উটগুলোকে সুস্থ পশুর দলে পাঠিয়ে দেবে না। (কারণ এতে ওই সুস্থ প্রাণীগুলো রোগাক্রান্ত হতে পারে।) (মুসলিম, হাদিস : ২৮৭৩)।
তাই আমরা সংক্রামক রোগকে মহান আল্লাহর হুকুমের চেয়ে শক্তিশালী ভাবার যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি কোথাও এ ধরনের রোগ দেখা দিলে তাকে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মেনে করোনাসহ যে কোনো মহামারিমুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন