বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে মাঘের তৃতীয় সপ্তাহের একেবারে শেষ দিকে আষাঢ়-শ্রাবণের মতো প্রায় একটানা ১২ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়ে গেল। এই বৃষ্টি মৌসুমি ফল-ফলাদির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসলেও উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আলুর জমিতে পানি জমে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এমনিতেই বাজারে আলুর দাম নেই। উৎপাদন খরচ নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে রংপুর অঞ্চলের আলু চাষীদের। রংপুরে পর পর দু’দিনের বৃষ্টিতে অধিকাংশ আলু ক্ষেতে পানি জমে গেছে। এতে করে মাটির নিচে থাকা আলুতে পচন ধরতে শুরু করেছে। আলু ক্ষেত থেকে বৃষ্টির পানি সেচে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের আলু চাষীরা
এ ছাড়াও গম, ডাল, সরিষা, কলাই জাতীয় ফসলের ক্ষতি ব্যাপক। তবে বোরো ধান চাষের জন্য এই বৃষ্টি ছিলো খুবই কাক্সিক্ষত। শীত ঋতুর শেষ দিকের বৃষ্টি প্রকৃতিকে সতেজ করেছে। বিশেষ করে আসছে মধু মাসের ফল আম, জাম, লিচু ও কাঁঠাল গাছের মুকুল, ফুল ও মোচার দ্রুত বের হওয়া ও বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ফলদায়ক হবে।
বগুড়া আবহাওয়া অফিসের মনিটরিং বিভাগ জানিয়েছে, বগুড়ায় গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মোটামুটি ওই সময় উত্তরের অপরাপর জেলাগুলোতে একই মাত্রায় বৃষ্টি হয়েছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলার মধ্যে রংপুরে ৯৭ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন। রংপুরে সাধারণত কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, গ্রানুলা, লেডিরসেটা, বারি আলু, কারেস, শীল, দেশি সাদা আলুর চাষ বেশি হয়।
বিশেষ করে রংপুরের গঙ্গাচড়া, পীরগাছা, মিঠাপুকুর বদরগঞ্জ ও কাউনিয়া উপজেলাসহ এক সময়ের পড়ে থাকা তিস্তার চরাঞ্চলগুলোতে আলুর বাম্পার ফলন হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চরাঞ্চলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আলু চাষ হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই এ অঞ্চলের কৃষকরা আমন ধান কাটার পর শীতকালীন ফসল হিসেবে আগাম আলুর চাষ করে আসছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মৌসুমি আলু চাষীরাও জমি বর্গা নিয়ে ব্যাপকভাবে আলু চাষ করেন। সুষ্ঠু পরিচর্যা আর অনুকূল পরিবেশের কারনে সবখানে ফলন বেশ ভালো হয়। কিন্তু মৌসুমের শুরু থেকেই বাজারে নতুন আলুর দাম না থাকায় বেকায়দায় পড়ে যান আলু চাষীরা। ফলন ভালো হলেও কাঙ্খিত দাম না থাকায় কৃষকদের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ নেমে আসে। গতকাল রংপুরের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ আলু ক্ষেতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। জমে থাকা পানি সরাতে জমির আইল কেটে, বালতি কিংবা বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে সেচে পানি সরানোর চেষ্টা করছেন কৃষকরা।
রংপুর অঞ্চলে আলু সংরক্ষণের জন্য রংপুরের ৫ জেলায় ৬৭টি হিমাগার রয়েছে। এরমধ্যে রংপুরে ৪০টি এবং নীলফামারী জেলায় ১০টি। বাকি তিন জেলায় আছে ১৭টি হিমাগার। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আলু উত্তোলন করা হয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে আলু পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে চাষীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
অন্যান্য বছর মৌসুমের শুরুতে বাজারে আগাম জাতের আলু ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও চলতি বছর শুরু থেকেই আলু ৩০ থেকে ৩৪ টাকা দরে বিক্রি হয়। বর্তমানে দাম ১০ থেকে ১২ টাকায় নেমে এসেছে। আর এ কারনে ভরা মৌসুমে আলুর দাম নিয়ে মারাত্মক শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চাষীরা। তারওপর মাঘের এমন বৃষ্টির কারনে অনেকেই ভাবছেন এবার আলুতে লাভ তো দুরের কথা উৎপান খরচ উঠানোই মুশকিল হবে।
এদিকে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. দুলাল হোসেন গতকাল রোববার ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় আলুর জমিতে পানি জমেছে। এসব জমিতে পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই। এ কারনে ওইসব জমির আলুর গাছ পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইতোমধ্যেই বগুড়া ও জয়পুরহাট অঞ্চলের জমি থেকে আলু উঠানো হয়েছে। তবে দেরিতে রোপন করা সরিষা ও আলুর কিছু ক্ষতি হবে। তিনি আরও জানান, ব্লক সুপার ভাইজাররা মাঠ পর্যায়ে আলু ও সরিষার ক্ষতির পরিসংখ্যান তৈরি করছেন। জরিপ সম্পন্ন হলে বলা যাবে ঠিক কত হেক্টর জমির আলু ও সরিষার ক্ষতি হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে কর্মকর্তা মো. দুলাল হোসেন বলেন, বোরো ধান ও সব ধরনের মৌসুমি ফলের জন্য এই বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি বোরো ধান ক্ষেতে কৃষকের সেচ খরচও কমিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টিতে অবশ্য বগুড়ার নন্দীগ্রাম, শিবগঞ্জ এবং জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল, পাঁচবিবির কৃষকদের কথা, তারা তাদের এলাকার নিচু জমির আলুর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
রংপুর ও নওগাঁর কয়েকজন আম চাষি, নাটোরের লিচু চাষি বলেছেন, ফল ও কৃষি বিজ্ঞানীরা তাদের জানিয়েছেন, মাঘের শেষের এই বর্ষণ সব ধরনের ফলের জন্য অনেক শুভ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন