আলোচিত পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতু হত্যার সাড়ে পাঁচ বছর পার হলেও এখনো দেয়া হয়নি চার্জশিট। শেষ হয়েও যেন হচ্ছে না তদন্ত। পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে। কিছুদিনের মধ্যেই দেয়া হবে চার্জশিট। আর এই চার্জশিটের অপেক্ষায় রয়েছে মিতুর পরিবার।
এনজিও কর্মীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক রক্ষা এবং নানা অপকর্মের প্রমাণ মুছতেই স্ত্রীকে হত্যার মতো নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নেন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। একপর্যায়ে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যায় কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের পথ খুঁজে নেন বাবুল আক্তার ও তার প্রেমিকা। হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাকে। বাবুলের পরিকল্পনা ও ইচ্ছাতেই মিতুকে খুন করাতে তিন লাখ টাকাও ঢালা হয়। আর বিশ্বস্ত লোকজনকে দিয়ে পরিকল্পনামাফিক মিতুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেন বাবুল।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই’র পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক। গত ৯ জানুয়ারি আদালত বাবুলকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন। গত ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে মিতুর বাবা মোশাররফের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একইসঙ্গে ওই মামলার ডকেট প্রথম মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের জন্য আবেদন করেন। যার শুনানির জন্য ২২ ফেব্রুয়ারি সময় নির্ধারণ করেছেন আদালত।
মামলার তদারকি কর্মকর্তা পিবিআইয়ের বিশেষ এসপি আহসান হাবীব পলাশ ইনকিলাবকে বলেন, মিতু খুনের সাথে সাবেক এসপি বাবুল আক্তার সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে আদালতে কয়েকজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাবুল আক্তারের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি আরো বলেন, মিতু হত্যাকান্ডের নেপথ্যে কারণ এরই মধ্যে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুনের মামলায় খুব শিগগির জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
নিহত মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বাবুল আকতারের সঙ্গে গায়ত্রী অমর শিং নামে এক এনজিও কর্মীর পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তার মেয়ের সঙ্গে বাবুলের ঝগড়া হয়। মৃত্যুর আগে মিতু বিষয়টি তাদের জানিয়েছিলেন। পারিবারিকভাবে তারা বিষয়টি সমাধানেরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি। একপর্যায়ে বাবুল ও ওই নারী মিতুকে মেরে ফেলার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মিতুর ছেলে মাহির। তার বয়স এখন ১৩ বছর। আমরা আদালতের কাছে আবেদন করেছি মাহিরকে হাজির করা জন্য। কিন্তু মাহির ও তার বোন কোথায় আছে তা এখন আমরা জানতে পারছি না। বাবুল ও তার লোকজন মিতুর দুই সন্তানকে লুকিয়ে রেখেছে। আমরা চাই মিতুর ছেলে মাহিরের জবানবন্দী নেয়া হউক।
মিতুর বাবা বলেন, মামলায় বাবুলসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে। বাকি সাতজনের নাম আগের মামলায় পুলিশের তদন্তে এসেছিল। আসামিরা হলেন- বাবুল আক্তার, কামরুল সিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ভোলা, মোহাম্মদ ওয়াসিম, মোহাম্মদ আনোয়ার, মোহাম্মদ শাহজাহান, মোহাম্মদ সাজু ও মোহাম্মদ কালু।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মুসা শুরু থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন। পরে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আবার মুসা ছিলেন বাবুল আক্তারের সোর্স। অথচ হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তের পর্যায়ে বাবুল আক্তার দাবি করেছিলেন, মুসাকে তিনি চেনেন না। মুসা দীর্ঘদিনের পরিচিত হওয়ার পরও সুকৌশলে তাকে শনাক্ত না করে জঙ্গিদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বলে দাবি করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন বাবুল।
পিবিআই সূত্র জানায়, বাবুল আক্তারের পূর্বপরিচিত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হক। সাইফুল হক ও গাজী আল মামুন নামে আরেক ব্যক্তি আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সাইফুল হক জানিয়েছেন, মিতু হত্যার তিন দিন পর তিনি বাবুল আক্তারের নির্দেশে গাজী আল মামুনের মাধ্যমে মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসাকে তিন লাখ টাকা দেন। গাজী আল মামুন সেই মুসার আত্মীয়।
মামুনও আদালতে জবানবন্দি দিয়ে টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। মূলত এই টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর পিবিআই নিশ্চিত হয়, মিতুকে হত্যার জন্যই এই তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এটি ছিল একটি কন্ট্রাক্ট কিলিং। বিকাশের মাধ্যমে এই টাকা লেনদেন হয়েছে। বিকাশের লেনদেনের সিøপও তদন্তকারী কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় মিতুকে। স্ত্রী খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ২০১৬ সালের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআই-এর ওপর। প্রায় দেড় বছর পর ২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়- তদন্তে বাদি বাবুল আক্তারের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
১২ মে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে গত বছরের ১২ মে মোশাররফের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বর্তমানে বাবুল আক্তার কারাগারে আছেন। ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর মামলার এক আসামি এহতেশামুল হক ভোলা আদালতে জবানবন্দি দিয়ে জানান, বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুন করায় পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার।
ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারও আদালতে জবানবন্দি দেন। তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এসব জবানবন্দির একপর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।
ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপরই মিতু হত্যার থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন