আমরা এখন ২০২২ সালে উপস্থিত হয়েছি। ক্যান্সার নির্মূল করার জন্য রেডিও থেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি একটি অতি মূল্যবান ভূমিকা পালন করে থাকে, সেটা রোগটির যে কোন পর্যায়ে হোক না কেন। সেই উনিশ শতকে ডীপ এক্সরে থেরাপি মেশিনের পর কোবাল্ট ৬০ মেশিন এবং এখন আধুনিক লিনিয়ার এক্সেলের এক্সেলেরেটর দিয়ে আমরা রেডিও থেরাপি মেশিনের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এখন অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সেলেরেটর এমনই যে আমরা ক্যান্সার রোগীকে ৩০ দিন চিকিৎসার পরিবর্তে পাঁচ দিনের মধ্যেই একই চিকিৎসা দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের সব হাসপাতলে এই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয় কারণ হিসেবে এখানে উল্লেখ্য যে অত্যাধুনিক ট্রুবীম লিনিয়ার এক্সেলেরেটর মেশিন ছাড়াও এখানে দরকার হয় অতি আধুনিক ৪ ডাইমেনশনাল সিটি স্ক্যানার মেশিন যার মাধ্যমে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসকে রেকর্ড করে সেটা কম্পিউটারের সাহায্যে দক্ষ ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ এবং মেডিকেল ফিজিসিস্টগণ অতি উন্নতমানের ট্রিটমেন্ট প্ল্যানিং কম্পিউটার এ পুরো চিকিৎসাকে পরিপূর্ণতা দিয়ে যাবে। তারপর সেই চিকিৎসা মেশিন দ্বারা পরিচালিত হয় দক্ষ রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট এর মাধ্যমে।
সুতরাং এই চিকিৎসার ব্যবস্থা একটি লম্বা শিকলের মত। এই শিকলে কোথাও এতটুকু ফাটল থাকলে উল্টো রোগীর সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। আমাদের হাসপাতলে ২০১৪ সালে এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা সবচাইতে প্রথমে শুরু হয়েছিল। এসবিআরটি মূলত প্রথমদিকে ফুসফুস ও যকৃত সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন প্রোস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার চিকিৎসাতেও এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে একটাই যে, এ ধরনের চিকিৎসা কেবলমাত্র ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন ধরা যাক, ফুসফুসের রোগের পরিমাপ সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে চার সেন্টিমিটার এবং টিউমারটি ফুসফুসের এক পাশে থাকলে ভালো। ফুসফুসের অন্য জায়গাতে রোগটির বিস্তার ঘটলে এই চিকিৎসা দেয়া যাবে না।
যকৃতের ক্যান্সারের বেলায় টিউমার এর মাপ সর্বোচ্চ ছয় সেন্টিমিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। যাদের ক্ষেত্রে অন্যান্য চিকিৎসা যকৃতে কাজ করে না তাদের বেলায় এই এসবিআরটি চিকিৎসায় অসাধারণ সফলতা লক্ষ্য করা গেছে এবং রোগীকে ৬ মাস থেকে ১ বছরও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
মস্তিষ্কের ক্যান্সার চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত হয় এসআরটি বা এসআরএস। সেখানে একই কথা প্রযোজ্য। মস্তিষ্কের টিউমার এর মাপ ছোট হতে হবে এবং এটি মস্তিষ্কের মূল অংশ ব্রেইন স্টেম থেকে দূরে থাকতে হবে। রেডিওথেরাপির এসবিআরটি চিকিৎসায় আমরা একসাথে অনেক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক্স রে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করি সেটা সনাতন এক্স রে থেকে ৫ গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। এইজন্য রোগীকে মাত্র ৫টা রেডিওথেরাপি দিয়ে পুরো চিকিৎসা সম্পন্ন করা যায়। মস্তিষ্কের ক্যান্সার চিকিৎসায় এসআরটি একই রকম। কিন্তু এসআরএস একটু ভিন্ন রকমের। এই পদ্ধতিতে ১ দিনেই পুরো রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয এবং এটি এই দেশেই সম্ভব হয়েছে।
একটি অসুবিধা হলো এই চিকিৎসাগুলো রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সার চিকিৎসায় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বাংলাদেশের রোগীরা ক্যান্সার চিকিৎসকগন এর কাছে অনেক দেরিতে চিকিৎসার এর জন্য আসেন তখন অনেক ক্ষেত্রেই এই অত্যাধুনিক চিকিৎসাগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।
তারপরও আমরা গর্বিত এ কারণে যে, উন্নত বিশ্বের মত এই দেশেও এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পূর্ণ সফলতা পাওয়া গেছে। এছাড়াও চার ডাইমেনশনাল সিটি স্ক্যানার এর সাহায্য নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস কে ৩০ সেকেন্ডের মত সাময়িক বন্ধ রেখে বাম স্তনের রেডিওথেরাপি এই চিকিৎসা ব্যবস্থা সফলভাবে সম্পন্ন করা গেছে। শরীরের বাম দিকে হৃদপিন্ড বা হার্ট থাকাতে অনেকাংশে আড়াআড়িভাবে রেডিওথেরাপি দেবার জন্য হৃদপিন্ডের অনেক ক্ষতি হতে পারে। সেটাকে পুরোপুরি কমানোর জন্য এই চিকিৎসা ব্যবস্থা। এটা হার্ট খুব পরিমাণ রেডিয়েশন পায় এবং যার কারণে এই ধরনের রোগীদের হার্ট অনেকদিন ভালো থাকে।
পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই আমরা হয়তো সব ক্যান্সার রোগীকে এই ধরনের অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রয়োগ করতে পারবো না তবে ৫ থেকে ১০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এই সব চিকিৎসা প্রয়োগ সম্ভব এবং এটাই আমাদের সফলতা। উন্নত বিশ্বের দেশের মতো বাংলাদেশেও এই আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসা ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক এটাই আমরা আশা করি।
ডাঃ মোঃ রশিদ উন নবী
সিনিয়র কনসালটেন্ট,
রেডিয়েশন অনকোলজী বিভাগ,
ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন