দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা সুবিধায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ক্যান্সার ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়েছে। ৫০ শয্যা থেকে প্রথমে ৩০০ বেডে, বর্তমানে ৫০০ বেডে সম্প্রসারিত হয়েছে। শুধু রেডিওথেরাপি বিভাগ দিয়ে শুরু হলেও আধুনিক বিশ্বের মত সার্জারি, কেমোথেরাপি, গাইনি, শিশু ক্যান্সার বিভাগ সহ অনেক বিভাগ সংযোজিত হয়েছে। প্রতিরোধ ও গবেষণার জন্য ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজি বা রোগতত্ব বিভাগ হয়েছে। ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য আলাদা কয়েকটি বিভাগ হয়েছে।
বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতাল উন্নতমানের ক্যান্সার চিকিৎসা সুবিধা চালু করেছে।
তবে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় বিপুল সংখ্যক ক্যান্সার রোগী ও ঝুঁকিপূর্ন মানুষকে কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
বেসরকারি বড় হাসপাতালগুলি সেবার উচ্চমূল্যের জন্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। একমাত্র সরকারি সমন্বিত বিশেষায়িত ক্যান্সার ইন্সটিটিউট সাধারন মানুষের ভরসাস্থল। তবে সারা দেশ থেকে আগত বিপুলসংখ্যক রোগীর কারণে দীর্ঘ অপেক্ষমান তালিকা দূর-দূরান্তের মানুষের অনেক কষ্টের কারণ।
তাই চিকিৎসা সুবিধা মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে বিকেন্দ্রীকরণের।
শুধু চিকিৎসা দিয়ে ক্যান্সার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের চারটি উপাদানঃ
১। প্রাথমিক প্রতিরোধ,
২। প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয়,
৩। নির্ণয় ও চিকিৎসা এবং
৪। প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ কেয়ার।
দুঃখজনক হলেও সত্য, চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য উপাদানগুলি সমান তালে বেড়ে উঠতে পারে নাই। শুধু চিকিৎসা নয়, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের সবগুলি উপাদান মিলেই ক্যান্সার সেবা - এই ধারণাটি সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হওয়া জরুরি।
প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন ও টিকাদানে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী ও পেশাজীবি সংগঠনগুলি একযোগে কাজ করা জরুরি। ইপিআই কর্মসূচী ও খাবার স্যালাইন জনপ্রিয় করার অভিজ্ঞতাতো আমাদের আছে। আলাদা আলাদা কার্যক্রম থাকলেও ক্যান্সার প্রতিরোধে সেই রকম সমন্বিত উদ্যোগ নেই।
লক্ষণ দেখা দিলেই যাতে সবাই হাসপাতাল বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, তার জন্য ক্যান্সারের সতর্ক সংকেতগুলি জনসাধারনকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্ক্রিনিং অর্থাৎ লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ আপাতঃসুস্থ ব্যক্তিকে ক্যান্সারের কিছু সহজ পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা ও এর মাধ্যমে গোপন থাকা ক্যান্সার রোগীদের খুঁজে বের করা, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশে জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই।
ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সহ প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান জানতে জনগোষ্ঠী ভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন এখনও চালু করা যায় নি।
নেই জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং এমনকি উন্নয়নশীল দেশেও বাস্তবায়ন সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ভায়া পরীক্ষাভিত্তিক জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর কর্মসূচি চালু হয় ২০০৫ সালে। পরবর্তীতে সরকার এই উদ্যোগে অর্থায়ন করে। স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর জন্য ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন অর্থাৎ চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষা পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪০০ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ভায়া সেন্টার চালু হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যা একটি বড় অগ্রগতি।
তবে ১৫ বছরে এই কর্মসূচী লক্ষ্যমাত্রার ১০% এর নীচে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। এই নিম্নহারের প্রধান কারণ:
১. জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচী হিসেবে প্রনীত ও পরিচালিত না হওয়া,
২. জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগসহ জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সম্পৃক্ত না হওয়া,
৩. প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানসহ স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ধাপে বিকেন্দ্রীকরণ না করা,
৪. চিকিৎসাকেন্দ্রভিত্তিক অসংগঠিত স্ক্রিনিং থেকে দীর্ঘ ১৫ বছরে সমাজভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিং-এ উন্নীত করার জন্য কার্যক্রম শুরু করতে না পারা,
৫. স্ক্রিনিং কেন প্রয়োজন, এটি যে ইনভেসিভ অর্থাৎ কাটাছেঁড়া বা কষ্টদায়ক কোন পরীক্ষা নয়, এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার যথেষ্ট উদ্যোগ না থাকা।
৬. পেশাজীবি, স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় ও স্থানীয় সংগঠনগুলোকে এই কাজে সম্পৃক্ত না করা,
৭. সর্বোপরি, স্ক্রিনিং যে কোন ক্লিনিক্যাল প্রোগ্রাম নয়, এটি একটি জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি, কর্মসূচি প্রণয়ন ও পরিচালনার কোন পর্যায়ে এই বিষয়টি প্রতিফলিত না হওয়া। সরকারের এ সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত জনবল থাকা সত্বেও কাজে না লাগানো।
বিগত বছরগুলোতে ক্যান্সার স্ক্রিনিং বিষয়ক বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সম্মেলনে বিএসএমএমইউ পরিচালিত ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর অর্জিত সফলতা ও দুর্বলতা আলোচিত হয়েছে। একে জাতীয় কর্মসূচীতে উন্নীত করে এর বাস্তবায়ন, তত্তাবধান, নিরীক্ষণ এর বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট জাতীয় প্রতিষ্ঠান, প্রোগ্রাম এবং বিএসএমএমইউ ও অন্যান্য পেশাজীবি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সম্পৃক্ত করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে।
মুখগহ্বরের ক্যান্সারকে অন্তর্ভূক্ত না করলে স্ক্রিনিং কর্মসূচী অসম্পূর্ণ ও খন্ডিত থেকে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এমনকি স্বল্প আয়ের দেশেও স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং বাস্তবায়ন করা সম্ভব। মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং পদ্ধতি অনেক সহজ। নারীপুরুষ নির্বিশেষে আমাদের দেশে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের হার অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে। গ্লোবোক্যান ২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর আক্রান্তের হারে মুখগহ্বরের ক্যান্সারের অবস্থান নারী-পুরুষ মিলে দ্বিতীয় ( ৮.৯%), পুরুষদের মধ্যে তৃতীয় (১০.৬%) ও নারীদের মধ্যে পঞ্চম ( ৬.৭%) স্থানে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সেবাকে রাজধানীকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত করে দেশের সব অঞ্চলের মানুষের কাছাকাছি নিতে হবে।
সরকার এ ক্ষেত্রে বিশাল উদ্যোগ নিয়েছে আট বিভাগে বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ১৮০ শয্যার অন্তঃবিভাগ, দিবা-কেন্দ্র, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, সর্বোপরি ক্যান্সার প্রতিরোধ, গবেষণা, নির্ণয় ও চিকিৎসার ৬টি বিশেষায়িত বিভাগ নিয়ে পূর্ণাংগ ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সাহসী ও দূরদর্শী প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ৯ জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে এই কেন্দ্রগুলির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপ্ন করেছেন।
সাধারণ মানুষ এখন তাদের নিজ ঠিকানার কাছাকাছি সরকারি এসব কেন্দ্রে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষায়িত ক্যান্সার সার্জন, কেমোথেরাপির জন্য মেডিকেল অনকোলজিস্ট, বিকিরণ চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, শিশুদের জন্য পেডিয়েট্রিক অনকোলজিস্ট, নারীরা জরায়ুসহ প্রজননতন্ত্রের ক্যান্সারের জন্য গাইনি অনকোলজিস্টের সেবা নিতে পারবেন, যা আগে একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউটেই পাওয়া যেত।
ক্যান্সার নিবন্ধন, প্রতিরোধ, গবেষণা ও সমাজভিত্তিক প্রতিরোধ ও স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজির পূর্ণাংগ বিভাগ অন্তর্ভূক্ত করা সরকারের সবচেয়ে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, যা ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এই প্রকল্পে প্রতিটি কেন্দ্রে ভ্রাম্যমান ক্যান্সার সচেতনতা ও স্ক্রিনিং ইউনিট অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সব জেলা ও উপজেলায় সুপরিকল্পিতভাবে সমাজভিত্তিক প্রতিরোধ ও স্ক্রিনিং সেবা দিবে।
উপরোক্ত বিষয়াবলী বিবেচনায় নিয়ে ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর জাতীয় কর্মসূচী প্রনয়ন করে, তাঁর আওতায় এনআইসিআরএইচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএসএমএমইইউ ও বাস্তবায়নাধীন ৮টি বিভাগীয় পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কেন্দ্র- এই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে যার যার অধিক্ষেত্র ও ম্যান্ডেট অনুযায়ী বাস্তবায়ন, নিরীক্ষণ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব দিয়ে নতুন উদ্যমে ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেবা সাধারন মানুষের দোরগোড়ায় নিতে ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে।
ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল,
ইমেইল: ruskin1963@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন