শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মৌলিক অধিকার হারানোর শঙ্কা আইনজ্ঞদের

বৈদেশিক অনুদান রেগুলেশন আইন

প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মালেক মল্লিক : জাতীয় সংসদে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন পাস হওয়ায় মানুষের মৌলিক অধিকার হারানো আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের আইনজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, আইনটি বাস্তবায়ন হলে মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবে। সবসময় ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকবে। সংবিধান স্বীকৃত চিন্তা, মত, বিবেক ও বাক্-স্বাধীনতা এবং সংগঠন বিষয়ক মৌলিক অধিকার খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলে আইনটির ১৪ ধারাকে উদ্ভট ও অযৌক্তিক বলে মনে করছেন তারা। এর আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ারপারসন হোসে কার্লোস উগাস বাংলাদেশ সফরে এসে নতুন আইনের ওই ধারাকে নাগরিক সমাজের কথা বলার সুযোগ সীমিত হবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ আইনটির ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন টিআইবিসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা। গতকাল মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারাও আইনটির তীব্র সমালোচনা করে তা বাতিলে দাবি জানিয়েছেন। এমনকি দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, এই আইনটি এনজিওর কাজে সহায়তার বদলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
গত ৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল পাস হয়। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ওই আইনের অনুমোদন দেয়ার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এই আইনের ১৪ ধারায় বলা আছে, সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক ও অশালীন মন্তব্য করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে এনজিও ব্যুরো সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন এনজিওর কাজকে বাধাগ্রস্থ করবে না বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, মানুষ স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারবে না। এ ধরনের আইন সংগঠন এবং মানুষের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করবে। এছাড়া যারা আর্থিকভাবে বেসরকারি সংগঠনগুলোকে সাহায্য করেন তারাও সাহায্য প্রদানে বিরত থাকবেন। আমি মনে করি এ ধরনের আইন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই সঙ্গে আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।
এদিকে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন ২০১৬ ও নাগরিক অধিকার’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিদেশি সাহায্য অনুদান নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে দুটি অর্ডিন্যান্স করা হয়েছিল। চার দশক পরে এসে নতুন আইন প্রণয়ন অনস্বীকার্য। নতুন আইনের খসড়া প্রণয়নের পরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মতামত নেয়া হয়েছিল। পক্ষগুলোর যে বিষয়গুলোতে আপত্তি ছিল সেগুলো মানা হয়নি। বরং চূড়ান্ত আইনে খসড়ার চাইতেও কিছু বিষয়ে বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আইনের ১৪ নম্বর ধারাকে ‘উদ্ভট ও অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, কঠোর সমালোচনা করতে পারার অধিকারটাই বড় গণতন্ত্র। যে যত বড়ই হোক না কেন তাঁর সমালোচনা করার সুযোগ থাকাটা গণতান্ত্রিক অধিকার।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এনজিওগুলো সরকারের সহায়ক শক্তি হতে পারে। সহায়ক শক্তিকে সহায়তা করার জন্য আইন হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে এই আইন এনজিওর কাজ বাধাগ্রস্থ করবে, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আর কোনো সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তির অশালীন বক্তব্যের জন্য সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বোধগম্য নয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এই আইনটি দ্রুত সংশোধন করা হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর আসিফ নজরুল বলেন, এই আইনে বলা হয়েছে, কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাঁরা কী কাজ করছেন আমরা দেখছি। ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালে কমিশনের সমালোচনা করতে পেরেছি আর ২০১৪ সালের নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করতে পারব না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভূয়া একটি নির্বাচন যদি হয়, সে নির্বাচনের বড় অংশ নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনের সমালোচনা করলে সুজন, টিআইবি’র মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন? তাহলে তো দেশে গণতন্ত্র, নির্বাচন বলে কিছু থাকবে না।
এর আগে গত মাসে সংবাদ সম্মেলনে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্র্যাক, গণসাক্ষরতা অভিযান, নিজেরা করি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ব্লাস্ট, বেলা, এফএনবি, এ্যাডাব, এএলআরডি, প্রিপ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, এ্যাকশন এইড, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ওয়াটার এইড, অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ কয়েক শতাধিক সংগঠন আইনটির ১৪ ধারা বাতিলে দাবি জানিয়েছিলেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মতে, এটি যেহেতু ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা-অপ-ব্যাখ্যার সুযোগ থাকবে, এটা বৈষম্যমূলক ভাবে এবং উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। তার ফলে যে প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে অধিকার ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা কাজ করে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটা হুমকি হিসেবে দাঁড়াবে। কারণ এ প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু সংবিধান এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কর্মে লিপ্ত। ব্লাস্ট-এর নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন মনে করেন এটি সবার জন্যই মারাত্মক ঝুঁকিপূণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন