বিশেষ সংবাদদাতা : কিছুদিন বন্ধ থাকার পর যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে আবারো বাস স্টপেজ চালু করা হয়েছে। ফ্লাইওভারের উপরে ৭টি স্থানে বাস দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব স্পটে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। গতকাল শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে রাজধানী মার্কেট সংলগ্ন স্থানে বাস থেকে নেমে পারাপারের সময় দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে একজন বাসযাত্রী ও মোটরসাইকেল আরোহী গুরুতর আহত হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কর্তৃপক্ষ ফ্লাইওভারের উপরে বাস স্টপেজ চালু করলে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় অবস্থিত ফ্লাইওভারে ওঠার সিঁড়িটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই সিঁড়িটির বিপরীতে একটি এবং সায়েদাবাদে আরও একটি সিঁড়ি তৈরী করে এক সাথে সবগুলো খুলে দেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে ফ্লাইওভার দিয়ে চলতে গিয়ে সময়ও বেশি লাগছে, জ্বালানীও বেশি খরচ হচ্ছে। আর কিছু দূর পর পর গাড়ি থামানোর ঝামেলা তো আছেই। গতকাল শুক্রবার বেলা সোয়া ১২টার দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের দিকে আসার সময় রাজধানী মার্কেটের কাছে একজন বৃদ্ধ আহত হয়ে পড়ে আছেন। তার পাশেই একটি মোটরসাইকেল দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। পেছনে দাঁড়ানো একটি বাস থেকে লোকজন নেমে সেই বৃদ্ধকে বাঁচানোর চেষ্টায় হাসপাতালে নেয়ার জন্য গাড়ি খুঁজছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃদ্ধটি ওই বাসের যাত্রী। তিনি রাজধানী মার্কেটের ওই মোড়ে বাস থেকে নেমে রাস্তা পারাপার হতে গেলে দ্রুতগামী একটি মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দেয়। এতে বৃদ্ধসহ ওই মোটরসাইকেল আরোহীও গুরুতর আহত হন। ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যারা নিয়মিত চলাচল করেন তাদের মতে, প্রতিনিয়ত এরকম দুর্ঘটনা ঘটছে। তাতে প্রাণহানি ঘটছে। বহু মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। কিন্তু তাতে ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। বরং তারা টাকার জন্য ফ্লাইওভারকে তাদের খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করছে। যারা টাকা দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠছে তাদের অসুবিধার বিষয়টিকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে শনিরআখড়া থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠলেই গতিসীমার সাইনবোর্ড। সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটারের (আগে ছিল ৬০ কি:মি:) দু’শ’ গজ পরেই ‘থামুন’ লেখা লাল সাইনবোর্ড। বাস ও টেম্পু দাঁড়ায় এখানেই। একই স্থান দিয়ে আবার লোকজন এপার থেকে ওপার যায়। সেজন্য লাল পতাকা হাতে দু’জন নিয়মিত ডিউটিও করে। তারাই লাল পতাকা দেখিয়ে চলন্ত গাড়িগুলোকে থামিয়ে লোকজন পারাপার করে। এসব কারণে সব ধরনের যানবাহন এখানে এসে হোঁচট খায়। কোনটা আচমকা ব্রেক করে থামানো হয়, কোনোটা পাশ কাটিয়ে বিপজ্জনক গতিতে চলে যায়। গত এপ্রিল মাসে এই স্থানে পর পর কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটার পর বাস থামানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। একই সাথে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ফ্লাইওভারে ওঠার সিঁড়িটিও। জানা গেছে, চালু হওয়ার পর থেকে ফ্লাইওভারের উপরে গত তিন বছরে দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও অপব্যবহারের কারণে দিন দিন যেনো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে হানিফ ফ্লাইওভার। এ নিয়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে নীরব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেছেন, ফ্লাইওভার একটি দ্রুতগতির অবকাঠামো। এখানে গণপরিবহন দাঁড়ানো বা যাত্রী ওঠানামা করানোর জন্য বাস স্টপেজ বানানোর জন্য পিএসসিসির কোনো অনুমোদন নেই বলে আমার ধারণা। সুতরাং যা কিছু করা হয়েছে, তা অবৈধভাবেই করা হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য এটা বন্ধ করা উচিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তার ঠিক উপরে ফ্লাইওভারের ওয়াল ভেঙ্গে সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে। এই সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীরা উপরে উঠে যাতে বাস দাঁড়ানোর স্থান পর্যন্ত যেতে পারে সেজন্য আলাদা লেন করা হয়েছে। লেন ধরে গেলেই মিলছে বাস, মিনিবাস ও টেম্পু। একইভাবে সায়েদাবাদ ও গুলিস্তানে ফ্লাইওভারের উপরে মানুষ ওঠার জন্য রাস্তা সরু করে পৃথক লেন বানানো হয়েছে। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে ডেমরার দিকে এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে পৃথক সিঁড়ি বানানো হয়েছে ফ্লাইওভারে ওঠার জন্য। এসব লেন ও সিঁড়ি দিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ ফ্লাইওভারে উঠছে। তাতে চলতে গিয়ে গাড়ির গতি কমাতে বাধ্য হচ্ছে চালকরা। কখনও কখনও মানুষের ভিড়ে ফ্লাইওভারের উপরেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে গাড়ি। আলাপকালে একাধিক গাড়ির মালিক ও চালক বলেছেন, আমরা টাকা দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠি যাতে সময় ও জ্বালানী দুটোই বাঁচে, আবার একই সাথে নিরাপদে যেতে পারি। কিন্তু ইদানিং ফ্লাইওভারে এমনভাবে মানুষজন চলাচল করে তাতে নিরাপদে যাওয়াই মুশকিল। ফ্লাইওভারের উপরে বাস, টেম্পু দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে, লাল পতাকা দেখিয়ে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দিয়ে লোকজন পারাপার করা হয়। এগুলোতে সময় জ্বালানী দুটোই নষ্ট হয়। তার মানে আমাদের কাছে থেকে টাকা নিয়ে কর্তৃপক্ষ প্রতারণা করছে। তারা কোনো সুবিধাই নিশ্চিত করতে পারছে না। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের দিকে আসার পথে কুতুবখালীতে ফ্লাইওভারের প্রবেশ মুখেই যানজট লেগে থাকে দিন রাত। ওই স্থানে ছোট বড় সব ধরনের বাস ও টেম্পু দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। এতে করে ফ্লাইওভারের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। সকালে ব্যস্ত সময়ে ওই স্থানে আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরে গাড়িগুলোকে যানজটে আটকে থাকতে হয়। ঠিক একইভাবে গুলিস্তান অথবা ঢাকা মেডিকেলের দিকে নামতে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়িগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়। গুলিস্তানে টোলকেন্দ্রে চারটি কাউন্টার থাকলেও তা গাড়ির তুলনায় অনেক কম। গাড়ির সারি ক্রমে লম্বা হয়ে কখনও কখনও টিকাটুলি ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলের দিকে যেতে মাত্র দু’টি কাউন্টার। এখানে রাত দিন ২৪ ঘন্টাই গাড়ির সারি দীর্ঘ থাকে। গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে নামতে গিয়ে গাড়ির তুলনায় অপর্যাপ্ত কাউন্টারের কারণে গাড়ির সারি দীর্ঘ হয়। এসব নিয়ে যাত্রীরা অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। নিয়মিত চলাচল করেন এরকম একজন যাত্রী বলেন, আমরা টাকা দিয়ে সময় বাঁচাতে এবং যানজট এড়াতে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাতায়াত করি। কিন্তু ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে পিক আওয়ারে কোনোদিনই যানজট এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। বরং নিচ দিয়ে গেলে এর চেয়ে আগে যাওয়া যেতো এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন