কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না কর্ণফুলী নদীর দখল-দূষণ। দখলে ছোট হয়ে গেছে দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ খরস্রোতা এই পাহাড়ী নদী। নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান থেমে যাওয়ায় বেপরোয়া দখলদারেরা। নদী দখল করে গড়ে উঠছে শত শত স্থাপনা। দুই পাড়ে ছোট-বড় কলকারখানা, অসংখ্য জাহাজ নৌযানের বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে মিশছে।
মহানগরীর প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষের পয়ঃবর্জ্যে বিষিয়ে উঠেছে লুসাই কন্যা কর্ণফুলী। পলিথিনসহ লাখ লাখ টন কঠিন বর্জ্যরে স্তর জমেছে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলীতে। দখল, দূষণ, ভরাটে কর্ণফুলীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। হুমকিতে দেশের অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দরও।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক সভায় সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, কর্ণফুলী নদী সাত ফুট ভরাট হয়ে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এ নদী আগামী ৫০ বছর টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন বলছে, ২০১৪ সালে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচে নদীর প্রস্থ ছিল ৮৬৬ মিটার। এখন তা ৪১০ মিটারে এসে ঠেকেছে। দখল ও দূষণের কারণে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা হারাচ্ছে কর্ণফুলী নদী।
বিগত ২০১৪ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে চাক্তাই খালের মুখে নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৯৩৮ মিটার। রাজাখালী খালের মোহনায় তা ছিল ৮৯৪ মিটার। কর্ণফুলী সেতুর নিচে ছিল ৮৬৬ মিটার। কিন্তু ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কর্ণফুলী সেতু থেকে ফিরিঙ্গিবাজার মনোহরখালী পর্যন্ত এর প্রস্থ জরিপ করে। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের জরিপের সাথে তুলনা করে এই জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে কর্ণফুলী সেতু এলাকায় নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৮৬৬ মিটার প্রস্থ। এখন তা ভাটার সময় ৪১০ মিটার এবং জোয়ারের সময় ৫১০ মিটার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। রাজাখালী খালের মুখে প্রশস্ততা ৮৯৪ মিটার থেকে ৪৬১ মিটারে নেমে এসেছে। আর চাক্তাই খালের মুখে এখন নদীর প্রশস্ততা ৪৩৬ মিটার। আগে যা ছিল ৯৩৮ মিটার।
জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কর্ণফুলী সেতুর উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে মাছ বাজার, বরফ কল ও অবৈধ নানান স্থাপনা। মূলত অবৈধ দখলের কারণে নদীর প্রশস্ততা কমে গেছে। একসময়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র চাক্তাই খালটি এখন নালা সদৃশ। চাক্তাই খালে সওদাগরী নৌকার বদলে দেখা যায় আবর্জনার স্তুপ। চাক্তাই খালসহ মহানগরীর বড় বড় খাল, নালা হয়ে বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে।
এক জরিপে দেখা গেছে, মহানগরীর কঠিন বর্জ্যরে মাত্র ৪০ ভাগ সংগ্রহ করে সিটি কর্পোরেশন। এসব বর্জ্য কর্পোরেশনের নির্ধারিত ডাম্পিং স্টেশনে ফেলা হয়। বাকি বর্জ্য খাল, নালা হয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। কঠিন বর্জ্যরে সাথে বিপুল পরিমাণ পলিথিন নদীতে পড়ছে। আর তাতে দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদী। চট্টগ্রাম মহানগরীতে এখনও গড়ে ওঠেনি সুয়্যারেজ সিস্টেম। ফলে নগরবাসীর পয়ঃবর্জ্যসহ তরল বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। তরলও কঠিন বর্জ্যে বিষিয়ে উঠেছে কর্ণফুলীর পরিবেশ। এতে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে গেছে অন্তত ৩৫ প্রজাতির মাছ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলীকে বাঁচানো না গেলে চট্টগ্রাম বন্দরকে বাঁচানো যাবে না। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর সুরক্ষায় নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। পরিবেশ অধিদপ্তর রুটিন কিছু অভিযান পরিচালনা করে তাদের দায়িত্ব সারছে। দখলদারদের বিরুদ্ধেও নেয়া হচ্ছে না কঠোর কোন ব্যবস্থা। বেপরোয়া পাহাড় নিধনের ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালু মাটিতে ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। একসময় পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও এখন প্রকাশ্যে চলছে পলিথিনের বেচাকেনা। প্রতিদিন টনে টনে পলিথিন খাল, নালা হয়ে নদীতে পড়ছে। আর তাতে দ্রুতই ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশ। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়েও নদীর নাব্যতা ফিরছে না।
থমকে আছে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের আইনজীবী মনজিল মোরসেদের একটি রিটের পর হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন বিগত ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট। এর আগের বছর হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নদীপাড়ের দুই হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। নগরীর সদরঘাট থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে উদ্ধার করা হয় ২০ একর জমি। এরপর ২০২০ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার চর এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। তবে এখনও পর্যন্ত কর্ণফুলী সেতুর আশপাশে দখল করে গড়েওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কবে অভিযান শুরু হবে সেটাও এখন অনিশ্চিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন