এনজিও, সমিতি এবং সমবায় সমিতির আড়ালে একটি প্রতারক চক্র বগুড়ায় দেড় যুগ ধরে প্রতারণার জাল বিস্তার করলেও অজ্ঞাত কারনে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। চক্রের একটি অংশ জামায়াত সংশ্লিষ্ট রাজনীতির সাথে জড়িত বলেও চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। বগুড়ার কিছু কিছু অঞ্চলে জামায়াতের কর্মী ও সমর্থক পর্যায়ে প্রচুর সংখ্যায় রয়েছে বিধায় চক্রটির পুঁজি সংগ্রহে খুব একটা অসুবিধা হয় না।
চক্রের হাতে শতশত মানুষ প্রতারিত হলেও দলীয় চাপে বা দলের ভাবমর্যাদা রক্ষায় জামায়াত সংশ্লিষ্টরা চুপ থাকতে বাধ্য হন। ফলে প্রতারক চক্রটি এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক জালিয়াতিতে উৎসাহিত হন। বগুড়ার সমাজসেবা ও সমবায় অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিগত চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলে বিপুল সংখ্যক জামায়াত ও সাবেক শিবির কর্মী সমাজসেবা অধিদফতর থেকে রেজিষ্ট্রেশন করে সঞ্চয় সমিতির কার্যক্রম শুরু করে।
ওই সময় সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে জামায়াতের মন্ত্রী থাকার সুযোগ নিয়ে সব ধরনের সরকারি অনুদান ও সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠেন সংশ্লিষ্টরা। সমাজসেবার নামকাওয়াস্তে রেজিষ্ট্রেশনকে পুঁজি করে তারা মাল্টিপারপাস কার্যক্রমের কথা বলে এনজিও/ব্যাংকের স্টাইলে মোটা অঙ্কের লাভের লোভ এবং ঋণ প্রদানের টোপ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে।
সংশ্লিষ্ট প্রতারকরা জামায়াত-শিবিরের বর্তমান বা সাবেক নেতাকর্মী হওয়ায় জামায়াত সমর্থক লোকদের কাছ থেকে সহজেই প্রচুর আমানত সংগ্রহে সক্ষম হন। এদের কথায় আচরণে ধর্মের লেবাস থাকায় বিশ^াস করে সাধরণ মানুষও আকৃষ্ট হয়।
উদাহরণ দিয়ে ভুক্তভোগি কয়েকজন জানালেন, বগুড়া শহরের অর্থনৈতিক জোন বলে পরিচিত বড়গোলার একটি বহুতল ভবনকে তারা বেছে নেয়। সেখানে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ নামে একটি সংস্থা জামায়াত কর্মী ও সমর্থকসহ শতশত সাধারণ মানুষের কয়েক কোটি টাকার পুঁজি হাতিয়ে সটকে পড়েন এর পরিচালকরা। পরে এরা ভিন্ন নামে বহাল তবিয়তে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
বগুড়া শহরের গালাপট্টি এলাকায় কয়েকজন সাবেক শিবির কর্মী একটি সংস্থা খুলে মাসে এক লাখে ১৫ হাজার টাকা লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে জেলাজুড়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করে। তারা গত পাঁচ বছরে শত কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহ করে। আর প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় একাধিক ক্লিনিক, আইপি টিভি, ই-কমার্স, এগ্রাবেইজড ও এয়ারট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে গ্রাহক ও অংশীদারদের আমানতের অর্থ বিনিয়োগের নামে মূলত বেপরোয়াভাবে আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যে কোন সময় এটির সাথে সংশ্লিষ্টরা লাপাত্তা হতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এই সংস্থার মূল ব্যক্তির সাথে একাধিকবার দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা করেননি। তবে তিনি বিভিন্ন সংস্থা এবং কিছু মিডিয়া পার্সনকে ‘অর্থ দিয়ে ম্যানেজ’ করেই তার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠালগ্নের অনেককেই কৌশলে এবং বল প্রয়োগে বের করে দেওয়া হয়েছে বলেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। একই কাজ করছে নামুজা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা (নিডো ) নামে আরেকটি সংস্থা। সংস্থাটির বগুড়া শাখায় গিয়ে এর কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য চাইলে ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মচারিরা কোন প্রকার তথ্য দিতে রাজি হননি।
বগুড়া সমবায় অধিদফতরের অধীনে তাঁত শিল্প সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে দখল করে সাবেক শিবির কর্মীরা। পরে সংগঠনটির প্রায় ৫ কোটি টাকার তহবিল তারা তছরুপ এবং ৬০ বিঘার মত বিশাল ভূ-সম্পত্তি হজম করে ফেলেছে। এই ঘটনায় সংস্থাটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জহুরুল ইসলাম হাজত বাস করেছেন।
তবে এই নয়ছয়ের সাথে বগুড়া জেলা সমবায় অধিদফতরের লোকজন জড়িত থাকায় বেহাত জমি ও তছরুপ করা টাকা উদ্ধারে সরকারি সংস্থাটির কোন তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। সম্প্রতি বগুড়া জেলা সমবায় কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখিত বড় ঘটনা ছাড়াও গত ৬ মাসে বগুড়ার তিন উপজেলায় চারটি সংস্থা গড়ে উঠেছে। এগুলো হচ্ছে আব্দুল মান্নান, মহসিন আলী, ইসমত আরা গং এর এসটিসি নামক একটি তথাকথিত এজেন্ট ব্যাংক ধুনট উপজেলায়। গাবতলী উপজেলার নশিপুর বাগবাড়িতে রূপসী বাংলা সমবায় সমিতি, রঞ্জু সরকার নামক এক ব্যক্তির রুদ্র ফাউন্ডেশন। সারিয়াকান্দি উপজেলায় বাঁধবাসী একতাবদ্ধ সমবায় সমিতি।
তিন উপজেলায় ওই চারটিসহ অপর একটি সংস্থা সাধারণ লোকদের মাসে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ এবং ঋণ দেওয়ার কথা বলেছে। এভাবে নিরীহ লোকদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার আমানত হাতিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে সর্বশান্ত করেছে মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন