হাসান সোহেল : অর্থনৈতিক এবং আর্থিক অপরাধ এখন বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই ব্যাংকে কোনো না কোনোভাবে আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। চেক জালিয়াতি, ঋণ ও আমানত হিসাবে জালিয়াতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-সংক্রান্ত জালিয়াতি এবং তথ্যপ্রযুক্তিঘটিত জালিয়াতি অহরহই ব্যাংকগুলোতে ঘটছে। এই জালিয়াতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র মানিলন্ড্রারিং করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ অপরাধে ব্যাংকের নিজস্ব লোক জড়িত। একই সঙ্গে দিনে দিনে মানি লন্ড্রারিংয়ের প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন তারা। এছাড়া অপরাধ শনাক্তে এবং ব্যাংকের নিরাপত্তায় প্রতিটি ব্যাংকের পৃথক গোয়েন্দা ইউনিট গঠনের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ব্যাংকে যে সম্পত্তি বন্ধক রাখা হচ্ছে, তা প্রকৃত কিনা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। সব কর্মকর্তাকে ব্যবসায়িক লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হচ্ছে। যে কারণে জালিয়াতি বাড়ছে। এ ছাড়া ব্যাংকের চেক এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ছাপছে। তাই চেক জালিয়াতির সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানও জড়িত থাকতে পারে বলে মত দেন তারা।
দেশের ব্যাংক খাতে আর্থিক জালিয়াতির বিষয়ে ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ৬৫ শতাংশ ব্যাংকে কোনো না কোনোভাবে আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। চেক-সংক্রান্ত জালিয়াতি হয়েছে ৬০ শতাংশ ব্যাংকে এবং ঋণ ও আমানত হিসাব নিয়ে জালিয়াতি হয়েছে ৬৫ শতাংশ ব্যাংকে। তবে মাত্র ১০ শতাংশ ব্যাংকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-সংক্রান্ত জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিঘটিত জালিয়াতি হয়েছে ৫৫ শতাংশ ব্যাংকে; অনৈতিক কর্মকা- ও অসততার মুখোমুখি হয়েছে ৬৫ শতাংশ ব্যাংক। তবে যেসব ব্যাংকে জালিয়াতি হয়েছে তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বলে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, জালিয়াতি রোধে ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের যেভাবে নজরদারি করার কথা, সেভাবে তা হচ্ছে না। নজরদারি বা তদারকি আরও জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকের ৯০ শতাংশ টাকা আমানতকারীদের। তাদের আমানতের নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ব্যাংক খাতে অপরাধ যেহেতু বেড়েছে, তাই প্রত্যেক ব্যাংকে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দাবাহিনী গঠন করতে হবে। এদের কাজ হবে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে পূর্বাভাস দেয়া। এদের পরিচয় সবার জানার দরকার নেই। তারা বর্ণচোরা হয়ে কাজ করবে। ইংল্যান্ডে এমনটি হয়েছে, বাংলাদেশও এ মডেল গ্রহণ করতে পারে। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি ভাবতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এসব অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, আইন প্রণয়নের বিষয়টি সন্তোষজনক। কিন্তু আইন প্রয়োগ করে পরিস্থিতির বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি বলেই আমি মনে করি। অর্থ পাচারের তেমন কোনো ঘটনাই ধরা পড়ছে না। অথচ এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য না যে, মানিলন্ডারিং হচ্ছে না। তিনি বলেন, বড় বড় কোনো ঘটনাই ধরা পড়ছে না। সন্ত্রাসে যে অর্থায়ন তা ধরতে কিন্তু পারেনি। আসলে এসব অপরাধ ধরার ক্ষেত্রে ইন্টেলিজেন্সের সক্ষমতার অভাব রয়েছে বলে আমি মনে করি।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে ব্যাংকে দেখা যায়Ñ পরিচালকরা ভাগাভাগি করে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। বলে তুমি আমার ব্যাংক থেকে নাও, আমি তোমার ব্যাংক থেকে নেব। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিনের খেলাপি হওয়া অর্থ ফেরত পেতে মামলা করে। কোর্ট থেকে সে মামলার স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার ঋণ নিচ্ছে খেলাপিরা। এ ধরনের ঋণ নেয়া বাংলাদেশ ব্যাংককে সার্কুলার করে বন্ধ করতে হবে। আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট কোনো ব্যাংকে নেই। এটা গঠন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ আদায় হয়েছে। বাকি টাকার হদিস নেই। এ টাকা আদায়ের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াছিন আলী বলেন, ব্যাংকে কিছু ব্যক্তি সব সময় অনিয়ম-দুর্নীতি করে। এতে সে নিজে ও অন্যকে বিপদে ফেলে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সৎ না হলে অপরাধ দমন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের ৯০ শতাংশ অপরাধে নিজেদের লোক জড়িত। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা যদি আর্থিক অপরাধী না হয় তাহলে কোনটিকে আর্থিক অপরাধ বলব? আসলে প্রত্যেকে নিজের অবস্থান নিয়ে চিন্তিত। চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। সে কারণে অনেক সময় জেনেও জানে না, বুঝেও বুঝে না। ব্যাংক খাতে সৎ লোক দরকার। কিন্তু চাকরি দেয়ার সময় সৎ-অসৎ খোঁজার কি কোনো ব্যবস্থা আছে?
দি সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মইনুদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অনিয়ম করে সেটা দুর্নীতি। আবার ব্যাংকের নিয়ম বা প্রক্রিয়া সঠিকভাবে না মানায় অন্য কেউ সুযোগ নিচ্ছে। এভাবেও অনিয়ম সৃষ্টি হয়। যদিও এখানে ওই কর্মকর্তা জেনে না জেনে দু’ভাবেই এ অনিয়ম করতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফারুক মইনুদ্দিন বলেন, বিভিন্ন ব্যাংকে অনিয়মের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু কোনো বিচার হচ্ছে না। একটি ব্যাংকের ৩৪০ কোটি টাকা পাচারের কথা শোনা গেল, কিন্তু আর কিছুই হলো না। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা হোক। এছাড়া ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অ্যাকাউন্ট খোলায় বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। এছাড়া অনিয়ম থেকে উত্তরণে ব্যাংকের নির্দিষ্ট নিয়ম সঠিকভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, অর্থনৈতিক ও আর্থিক অপরাধ এখন বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা মোকাবেলা করে আমাদের এগোতে হচ্ছে। বিশেষ করে মানি লন্ডারিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন