ইনকিলাব রিপোর্ট : নড়বড়ে বেড়িবাঁধে দেশের উপকূলজুড়েই এখন আতঙ্ক। ষাট এর দশকে নির্মাণ করা এসব বাঁধ এখন নামেই টিকে আছে। অনেক এলাকায় বাঁধের কোন অস্তিত্বও নেই। আবার অনিয়ম ও দুর্নীতি গিলে খেয়েছে অনেক এলাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণের সিংহভাগ অর্থ। শুধুমাত্র দশ বছরেই চট্টগ্রামে ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বেড়িবাঁধ নির্মাণে। ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশালে ব্যয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকারও বেশি। ফেনী ও নোয়াখালীতে ব্যয় হয়েছে ২৪০ কোটি টাকা। আর সাতক্ষীরা ও খুলনায় ব্যয় হয়েছে ৫৮০ কোটি টাকার উপরে। এত টাকা ব্যয় করেও উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ আজও ঝুঁকিমুক্ত হয়নি। বরং ২১টি উপকূলীয় জেলার অধিবাসীদের দিন কাটে চরম আতঙ্কে। সারাদেশে ১১ হাজার ৪৩০ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ১৬০ কিলোমিটার হচ্ছে উপকূলীয় বাঁধ। উপকূলীয় বাঁধে মধ্যে প্রায় ২৩শ’ কিলোমিটার বাঁধ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ষাটের দশকে করা এসব বাঁধ এখন স্থান ভেদে এক থেকে দুই মিটার পর্যন্ত উঁচু করা প্রয়োজন।
জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল ও বরগুনা জেলায় প্রায় ২৬শ’ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার কিলোমিটার বাঁধই এখন অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে এসব এলাকার বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকির পরিমাণ আরও বাড়ছে। বরিশাল জোনে সিইআইপি প্রকল্পের আওতায় ২০৪ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও আগামী বছর এই কাজ শুরু হবে। এই এলাকার বাঁধ গড়ে এক মিটার পর্যন্ত উঁচু করা হবে বলে এই জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাজেদুর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে জানান। কক্সবাজার জেলায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধের প্রায় ১০০ কিলোমিটারই ক্ষতিগ্রস্ত। এতে করে ঝুঁকির মুখে পড়েছে এখানকার পাঁচ উপজেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এই জেলায় উপকূলবর্তী এলাকায় ২১টি পোল্ডারে ৫৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলায় ৬০-এর দশকে প্রতিরক্ষামূলক বেড়িবাঁধ তৈরি হয়। এখানে মোট ৮৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে জেলার প্রায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। খুলনায় দাকোপের ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডারের ১৫টি স্থানে ভেঙে গেছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ার নলচিরা বেড়িবাঁধটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। ফেনীর ফুলগাজীর মুহুরী ও কহুয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ ১০০ কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। মুহুরী নদীর সাহপাড়া ২০ মিটার ও উত্তর দৌলতপুরে ৩০ মিটার এবং কহুয়া নদীর বৈরাগপুরে ৩০ মিটার, উত্তর জগতপুর, শ্রীচন্দ্রপুর ও দক্ষিণ জগতপুরসহ ছয়টি অংশ ভেঙ্গে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এই অংশ মেরামত করা হবে। তবে বাঁধ মেরামতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জোয়ার-ভাটার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের জমি প্রতিদিন দু’বার লোনা পানিতে প্লাবিত হয়। ষাটের দশকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড উপকূলীয় অঞ্চলে ১৩৯টি ফোল্ডার নির্মাণ করে। এর ফলে ওই সব অঞ্চলে ১.২ বিলিয়ন হেক্টর জমি উৎপাদনের আওতায় আসে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই সময় শুধু জোয়ার-ভাটার কথা বিবেচনা করে উপকূলীয় জেলাগুলোয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের কথা সেভাবে মাথায় নেয়া হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক বেড়িবাঁধ নষ্ট হয়। কোথাও কোথাও তা বিলীন হয়ে যায়। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাস, ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ সালে আইলায় উপকূলীয় অনেক জেলার বেড়িবাঁধ ভেঙে স্থায়ী জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দেয়।
এসব ক্ষতির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক ৪০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদানে সম্মত হয়। বিশ্বব্যাংকের সহায়তার প্রথম অংশ হিসেবে কোস্টাল এমবেনকমেন্ট প্রজেক্ট, ফেইজ-১-এর জন্য তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়নপূর্বক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে গত বছরের ১ অক্টোবর একনেক সভায় তা অনুমোদন হয়। একই বছরের ২৭ অক্টোবর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়।
জানা যায়, এই প্রকল্পের অধীনে ছয়টি জেলায় ৬২৫ কিলোমিটার বাঁধ তিন ফুট উঁচু করা হবে। ৪৮ হাজার ৫২৯ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃখনন করা হবে। ১২৪টি পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। দুই হাজার ২০৫ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণকাজ ছাড়াও ৯টি ক্লোজার নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে এই প্রকল্পের আওতায় খুলনা জেলার ৩২ ও ৩৩ এবং বাগেরহাট জেলার ৩৫/১ ও ৩৫/৩ এ চারটি পোল্ডারের পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ চলছে। এর মধ্যে বাগেরহাট জেলার দুটি পোল্ডারের জন্য ১০৪ হেক্টর জমি ও খুলনা জেলায় ১৯৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে ছয়টি জেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এক লাখ ৮১৭ হেক্টর জমি ঘূর্ণিঝড়ের সময় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাবে। ৮৬ হাজার ৩৮২ হেক্টর এলাকায় শস্য উৎপাদন বাড়বে। সুন্দরবনের বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র রক্ষা পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন হবে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর কবীর ইনকিলাবকে বলেন, উপকূলীয় বাঁধগুলো দ্রুত সংস্কার ও মেরামত করা প্রয়োজন। কিন্তু পর্যন্ত অর্থ ছাড়া তা মেরামত সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সাগরের পানির উচ্চতা এবং গ্লোবাল ওয়ারমিংকে বিবেচনায় নিয়েই উপকূলীয় এলাকার বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন