এসএমইকে অর্থনীতির প্রাণ বলা হলেও এখনো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বান্ধব হয়নি দেশের ব্যাংকিং খাত। আর এ জন্যই করোনাকালীন প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বরাদ্দ থাকার পরও কাঙ্খিত ঋণ পাচ্ছেন না অর্থনীতির এই কারিগররা। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক কুটির শিল্প, ছোট ও ক্ষুদ্রশিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের জামানত না থাকে বা অপর্যাপ্ত জামানত থাকে এমন উদ্যোক্তাদের ঋণের গ্যারান্টি দেবে এ ধরণের ব্যবসা বান্ধব উদ্যোগও নেয় সরকার। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের লক্ষ্যও ছিল। দীর্ঘদিন পর হলেও এ ধরনের ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ আর্থিকখাতসহ সর্বমহলে প্রশংসাও পায়। এমনকি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ৩৭টি ব্যাংক গ্রাহকদের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সার্ভিস প্রদান করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতিটি ব্যাংক এই সেবার জন্য ৩ জন কর্মকর্তাকেও নির্দিষ্ট করে দায়িত্বও দেয়। যারা শুধুমাত্র এই কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত। অথচ চুক্তি করেও ২৫টি ব্যাংক একজন গ্রাহককেও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সুবিধা প্রদান করেনি। অথচ প্রতিদিনই দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরছেন ছোট অঙ্কের ঋণের জন্য।
করোনায় বিপর্যস্ত দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকের মাধ্যমে করোনাকালীন প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পাওয়া নিয়েও এমন অভিজ্ঞতাই হয়েছে জয়িতা ও এসএমই ফাউন্ডেশনের। বাধাগুলো বিশ্লেষণ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহজে ঋণ দেয়ার পথ বের করার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
ইশরাত জাহান চৌধুরী। কাজ করেন পাটপণ্য নিয়ে। করোনাকালে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অর্থের দরকার হয়েছিল তার। ঋণের আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু পাননি। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নেই উদ্যোগকে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, আমি ঋণের জন্য আবেদন করেছিলাম কিন্তু পাইনি। এমনকি আমার পরিচিত কেউ ঋণ পেয়েছেনÑএমন কাউকেও দেখিনি। তার মতোই আবেদন করে এখনো প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ পাননি অনেক উদ্যোক্তা। তাদের অভিযোগ, বড় ব্যবসায়ীদের মাপকাঠিতেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের হিসাব মেলাতে চায় ব্যাংকগুলো। অনেকেই আবার অভিযোগ করেছেন, ব্যাংকগুলো সরকার-নির্ধারিত ৪ শতাংশ সুদহার না মেনে ৯ শতাংশ সুদ আদায় করছে।
তথ্য বলছে, করোনার ধাক্কা সামলাতে ২০২০ সালে ৮টি সংস্থার অধীন ৪ শতাংশ সুদহারে এসএমই খাতে দেড় হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ দেয় সরকার। এরই মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি পৌঁছে গেছে উদ্যোক্তাদের হাতে।
তবে, ব্যাংকের মাধ্যমে শতভাগ বরাদ্দ বিরতণকারী সংস্থা জয়িতা ও এসএমই ফাউন্ডেশনের অভিজ্ঞতা, ব্যাংকিং চ্যানেলে উদ্যোক্তার কাছে ঋণ পৌঁছাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাদের। এ ব্যাপারে জয়িতা ফাউন্ডেশনের পরিচালক নিপুল কান্তি বালা বলেন, আমাদের অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তা অফিশিয়াল ডকুমেন্টগুলো মেনে চলেন না। এতে ব্যাংক তাদের ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হলে আমাদের একটি বিকল্প সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। গতানুগতিক ব্যাংকিং ধারা অনুসরণ করে ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কারণেই এসএমই খাতে ঋণ দেয়ার আলাদা ব্যাংকিং নীতিমালা করার তাগিদ অর্থনীতিবিদদের। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে যাতে করে সহজে ঋণ পৌঁছে এবং সহজে যাতে তারা ঋণ ফেরত দিতে পারে, সে রকম একটি নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বছরের পর বছর ধরে উদ্যোক্তা উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। তারপরও এই করোনার সময়ে অর্থনীতিকে শক্তপোক্ত রাখতে উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহযোগিতা করতে চেয়েও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের হাতে অর্থ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, এই যে ব্যর্থতা, এখান থেকে উত্তরণে কি পথ বের করেন সংশ্লিষ্টরা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, দেশের ছোট উদ্যোক্তারা করোনায় বিপর্যস্ত। তাই দেশের স্বার্থে, কর্মসংস্থানের স্বার্থে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সহজে ঋণ দেয়ার পথ বের করার আহবান জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন