রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান সঙ্কটের তাপ এসে স্পর্শ করতে পারে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মাইল দূরের বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থায়ন করছে রাশিয়া। তবে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে কোনো ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা নেই। গতকাল রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব পরমাণু সংস্থা রোসাটম এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে, রাশিয়া ইউক্রেন সঙ্কটের মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মস্কোর অর্থায়ন নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়ার কিছু ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অর্থায়নে কোনো প্রভাব পড়বে কি না সেটি যাচাই করে দেখবে তারা। তাদের দাবি, প্রকল্পটির অর্থায়নে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন।
তারা বলেছেন, প্রকল্পটিতে ঋণ হিসেবে অর্থের বড় অংশের যোগান দিচ্ছে রাশিয়ার যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ভিবি ব্যাংক, সেই ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান বলেছেন, পারমাণবিক প্রকল্পের কাজে এখনও কোনো সমস্যা তারা দেখছেন না।
তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ যা হয়, কোনো একটি কাজ শেষ হলে বা টার্গেট পুরো হলে, তখন এখান থেকে আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে সার্টিফিকেট দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে যে প্রতিষ্ঠান সেই কাজটি করে, সে প্রতিষ্ঠানকে রাশিয়ার ফেডারেশনের পক্ষে ব্যাংকগুলো থেকে পেমেন্ট দেয়া হয়। জিয়াউল হাসান আরও বলেন, প্রকল্পে এখন রাশিয়া, ইউক্রেন এবং কাজাখস্তানের চার থেকে ছয় হাজার লোক কাজ করছে। আর আমাদের দেশীয় শ্রমিকসহ মোট ২৬ হাজারের মতো লোকবল রয়েছে। তাদের পেমেন্টেরতো কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি বলেন, প্রকল্পে কাজ পুরোদমে চলছে এবং এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যার খবর আমরা পাইনি।
তবে প্রথম ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ যে দুটি রাশিয়ান ব্যাংকের ওপর অবরোধ দিয়েছে তার একটি সে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ভিইবি। যেখান থেকে আসছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থায়ন। সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ বা সোয়া ১১ বিলিয়ন ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু সেখান থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এসেছে মাত্র ৪ বিলিয়ন। তাই অবরোধের পর বাকী অর্থ আদৌ আসবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় অর্থনীতিবিদরা। অবশ্য পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আমাদের কাজের অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। সেখানে প্রভাব ফেলবে না।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর বলেন, এই প্রকল্প যদি মাঝ পথে আটকে যায় তাহলে এই ঋণের ভার কে নেবে? আর এটা যদি কোনো কারণে অসমাপ্ত থেকে যায় তাহলে তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে?
অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, টাকার লেনদেন কীভাবে হবে? ব্যাংকগুলোই যদি আন্তর্জাতিক লেনদেনে নিষেধাজ্ঞায় পরে তাহলে তো এই ইস্যুতেই আটকে যাব আমরা। ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, ফাইনান্সিয়াল ট্রানজেকশন হতে পারে, বিজনেস ট্রানজেকশন হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিন্তু যারা নিষেধাজ্ঞা ইস্যুকারী দেশ তারা বাংলাদেশকেও শাস্তির আওতায় আনতে পারে।
এমন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনকারিও কি কালো তালিকায় পরতে পারে- এ প্রশ্নের জবাবে ড. আহসান মনসুর বলেন, এমনটা হলে আমরাও এই তালিকায় পরতে পারি। কারণ আমেরিকার ধারা যে লঙ্ঘন করবে তাকেও কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞায় নিয়ে আসা হবে।
হামলার জবাবে অবরোধের এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের অবস্থান কি হওয়া উচিত সেটাও পরিষ্কার করলেন অর্থনীতিবিদরা।
ড. আহসান মনসুর এ বিষয়ে বলেন, যে অভিযোগ আসবে তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য কিনা। যদি প্রযোজ্য হয় তাহলে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হতে পারে। যেহেতু প্রজেক্ট অর্ধেকের মধ্যে রয়েছে তাই এটা শেষ করা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
এছাড়া ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, আমাদের এই ঝুঁকিগুলো এখনই বিশ্লেষণ করে কখন, কোন দিক থেকে আসতে পারে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রস্তুত করে রাখতে হবে। ভবিষ্যৎ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আরও দক্ষ ও দূরদর্শী হবার বিকল্প নেই বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন