’আল্লাহু আল্লাহু’ ’লা ইলাহা ইল্লাল্লা’ ’লা ইলাহা ইল্লাল্লা’ ধ্বনিতে ছয়টি বিশাল ময়দান মুখরিত। বিশাল বিশাল শামিয়ানার নীচে আগত মুসলমানদের তিল ধরার ঠাঁই ছিল না। দুনিয়ার প্রার্থিক কোনো কিছু পাওয়ার মানসে নয়; একমাত্র রূহানী খোরাক, আল্লাহমুখী হওয়া ও তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যেই সারাদেশ থেকে লাখ লাখ মুসলমান ঐতিহাসিক চরমোনাইতে ফাল্গুনের তিন দিনব্যাপী মাহফিলের এসব ময়দানে জড়ো হয়েছিলেন।
উত্তরাঞ্চল থেকে চরমোনাই ময়দানে আগত আব্দুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের বাপ দাদারা যুগ যুগ ধরে এই দরবারে আসতেন একমাত্র আল্লাহমুখী ও তাকওয়া অর্জনের জন্য। চরমোনাই দেখতে আসছেন কী না এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল্লাহ বলেন, চরমোনাই পীরের দরবারে আমাদের চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এখানে যেসব আমলের বয়ান ও দুনিয়া আখেরাতের দিক নির্দেশনা দেয়া হয় তা’হাসিলের জন্যই সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। বাকিটা আল্লাহ কবুল করার মালিক।
বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরে ঐতিহাসিক চরমোনাই ময়দানে তিন দিনব্যাপী মাহফিলে লাখো মুসল্লির পদচারণা ও আল্লাহু ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সরেজমিনে চরমোনাই গিয়ে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। আসলে নদী বেষ্টিত দ্বীপ চরমোনাই ধর্মীয় মনোরম পরিবেশ দেখে সকলেরই মন ভরে যায়। চরমোনাইর মরহুম দাদা হুজুর মাওলানা ইছহাক সাহেব (রহ.) এর নিকট আত্মীয় সুফি মাওলানা আহসানুল্লাহ (রহ.) ১৯২৪ সালে চরমোনাইর দ্বীপে একটি ছোট্ট কুড়ের ঘরের মাধ্যমে মক্তব দিয়ে মাদরাসার কার্যক্রম চালু করেন। বর্তমানে চরমোনাইতে কওমি মাদরাসা, আলিয়া মাদরাসা, কোরআন শিক্ষা বোর্ড, কেরাতুল কোরআন মাদরাসা ও মহিলা মাদরাসায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ছাত্র ছাত্রী দ্বীনি শিক্ষায় অধ্যায়নরত।
লিল্লাহ বোডিংয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্র খাওয়া দাওয়া করেন। চরমোনাই আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মাহফিল কমিটির সদস্য সচিব মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল, পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া এবং তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে সারাদেশের মুসলমানরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চরমোনাই বার্ষিক মাহফিলে অংশ নিয়ে থাকেন। বিশাল এ মাহফিলের মূল স্টেইজ থেকে বয়ান ও নামাজের ফাঁকে ফাঁকে বি বাড়িয়া জেলার মাওলানা আব্দুল মালেক ফরাজীর সুমধুর কন্ঠে জিকিরে উপস্থিত মুসলমানরা আবেগাপ্লু হয়ে উঠেন। এসময়ে আল্লাহভিরু সাধারণ মুসলমানদের চোখ দিয়ে পানি গড়াতে দেখা যায়।
যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্বির্য পরিবেশে গত শুক্রবার বাদ জুমা চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের উদ্বোধনী বয়ানের মধ্যদিয়ে তিন দিনব্যাপী মাহফিলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। উদ্বোধনী বয়ানে পীর সাহেব চরমোনাইন মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন, দুনিয়ার কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য চরমোনাই মাহফিলে আসা যাবে না। একমাত্র হেদায়েতের নিয়তে এবং আল্লাহমুখী হবার লক্ষ্যে চরমোনাই মাহফিলে আগমন করতে হবে। পীর সাহেব বলেন, পাপ কাজ পরিহার এবং নেক আমলগুলো বেশি বেশি করতে পারলেই দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তির নাগাল পাওয়া যাবে। আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দান করুন। তিনি বলেন, যাদের কাছে ওয়াজ মাহফিল ভালো লাগে না তারা পথভ্রষ্ট। ঐতিহাসিক চরমোনাই মাহফিল কমিটির সদস্য সচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী আরো বলেন, এবার চরমোনাইতে ছয়টি বিশাল মাঠে সারাদেশ থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নৌ পথ ও সড়ক পথ জড়ো হতে থাকেন। মাঠগুলোর ওপর ছালার চট বাশ দিয়ে বিশাল শামিয়ানা তৈরির কাজ শুরু হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে।
দেশের আনাচে কানাচে থেকে আল্লাহর পাগলরা কাফেলা নিয়ে দলে দলে ছুঁটে এসেছিলো চরমোনাইর পানে। মুখে ছিলো আল্লাহর জিকির আর হৃদয়ে আল্লাহভীতি। জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাতে যাওয়ার যন্ত্রণায় তারা কাতর ছিলো প্রতিনিয়ত। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মাহফিল অনুষ্ঠানের লক্ষে মুজাহিদ কমিটির শত শত স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা ময়দানে কঠোর দায়িত্ব পালনে ছিল সদাজাগ্রত। মাহফিলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও সজাগ ছিল। সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয় মাহফিলের ময়দান। মাহফিলের দ্বিতীয় দিনে বৈরি আবহাওয়া এবং গুড়ি গুরি বৃষ্টি শুরু হলেও খোলা আকাশের নীচে অবস্থানকৃত মুসল্লিদের মাঝে কোনো হুড়াহুড়ি অথবা ছুটাছুটি লক্ষ্য করা যায়নি।
চরমোনাই মাহফিল প্রতি বছর হয়ে যায় নীরবে নিভৃতে। তবুও প্রতি বছর অগ্রহায়ন ও ফাল্গুনের মাহফিলে লাখ লাখ আল্লাহ ওয়ালারা আত্মশুদ্ধির মিলন মেলায় জড়ো হন। তারা জড়ো হয় আল্লাহর বিধি বিধান জেনে শুনে মেনে চলার তাগিদে। হাজারো অপরাধী চরমোনাই মাহফিলে গিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই’র বয়ান শুনে তারা পেয়েছে আল্লাহর পরিচয়। চরমোনাই মাহফিলে উপস্থিত হওয়া শ্রোতাদের জন্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নেই কোনো খাওয়ার ব্যবস্থা। মাইক, লাইট, উপরে শামিয়ানা টানিয়ে দিতেই কে হিমসিম খেতে হয় প্রতিনিয়ত। প্রতি মাহফিলে শ্রোতাদের জন্য মাঠ বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। এবারের মাহফিলে শ্রোতাদের জন্য ৬ টি মাঠ তৈরি করতে হয়েছে। মাহফিলে আগত বিশাল জনগোষ্ঠীর টয়লেট, বাথরুম, অজু গোসলের জন্য মাহফিল কর্তৃপক্ষের আয়োজনের পাশাপাশি স্থানীয়রা ও নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা করে থাকেন।
মাহফিলে আগত মুসল্লিদের ৫ হাজার গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কীর্তনখোলা নদীর দিকে প্রায় ৩ কিলোমিটার যায়গায় বিপুল সংখ্যক লঞ্চ নোংগর করে রাখা ছিলো। বরিশালসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও অন্যান্য যানবাহন যোগে মাহফিলে মুসলমানরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়ো হন। আগত মুসলমানরা ট্রলার ভাড়া করে চরমোনাই লঞ্চ ঘাটের ওপারে চরে গিয়ে প্রতিদিন নদীর পানিতে গোসল সেরে আসতেন। ওপারের চরে মাঝে একাধিক অস্থায়ী গণশৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাহফিলের শামিয়ানাগুলোতে অবস্থান নেয়া লাখ লাখ মুসলমানের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে চরমোনাই মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের কঠোর পরিশ্রম করতে দেখা গেছে। আশপাশের গ্রামবাসিরাও মাহফিলে আগত অনেক মুসলমানকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। মূল মসজিদের পূর্ব পার্শ্বে মরহুম পীর সাহেবদের কবরের সামনে কোনো প্রকার শরীয়ত বিরোধী কার্যক্রম করতে দেয়া হয়নি। শামিয়ানার নীচে যেসব মুসলমান স্থান পাননি তারা খোলা আকাশের নীচে রাস্তার পার্শ্বেই ছালা বিছিয়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে। এতে তাদের মাঝে কোনো প্রকার ক্ষোভ বা অসন্তোষ পরিলক্ষীত হয়নি। মাহফিলের আখেরি মোনাজাতের দু’ঘন্টা আগেই অগণিত মানুষকে স্ব স্ব লঞ্চে ও ট্রলারে অবস্থান নিয়ে মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা গেছে। এসময়ে মুসল্লিদের কান্না জড়িত কন্ঠে আল্লাহুম্মা আমিন আল্লাহুম্মা আমিনে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
এছাড়া অস্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১০০ শয্যার হাসপাতাল। যাতে দেশের নামিদামি চিকিৎসকরা স্বেচ্ছায় ফ্রি চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষ ঔষধ বিতরণ করেছেন। হামদর্দসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প করে অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা দিয়েছে।
মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম (রহ.) সাত সন্তান আজ মানুষের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত পৌছে দিচ্ছেন নিরলসভাবে। দলের আমীর পীর সাহেব মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম ও দলের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশের লাঞ্চিত, অধিকার বঞ্চিত মজলুম জনতার অধিকার আদায় এবং ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আজীবন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন বলেও তারা বহুবার ঘোষণা দিয়েছেন।
পীর সাহেব চরমোনাইর রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ইনকিলাবকে বলেন, মানুষ দিন দিন বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন তাকওয়া অর্জন এবং আল্লাহভীরু না হওয়া পর্যন্ত দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি নেই। তাই প্রতিবছর চরমোনাই বার্ষিক মাহফিলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগমনের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চরমোনাই মাহফিলে আগত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম ইনকিলাবকে বলেন, ধর্মীয় জ্ঞানার্জন থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। হক্কানী পীর চরমোনাই দরবারে এসেছি আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর সঠিক দিশা লাভের আশায়। তিনি বলেন, আমরা মুসলমান হয়েও অনেক গুমরাহির মাঝে নিমজ্জিত। তিনি দ্বীনের সঠিক দরস লাভের জন্য হক্কানী আলেম ও পীর মাশায়েখদের ছোহবতে থাকার গুরুত্বারোপ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন