ভয়ংকর মাদক আইসের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ করেছে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৫। গত বুধবার রাতে র্যাব গোয়েন্দা শাখার সহযোগিতায় র্যাব-১৫ এর একটি দল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে আইস কারবারের ৫ জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- চক্রের প্রধান মো. জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম, মকসুদ মিয়া, মো. রিয়াজ উদ্দিন, শাহিন আলম ও মো. সামছুল আলম।
গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ১২ কেজি ‘আইস’ (যার আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি টাকা), এক লাখ পিস ইয়াবা, ৪ হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, ২টি বিদেশি পিস্তল, ৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২টি টর্চলাইট, ১ লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা ও এক লাখ বার্মিজ মুদ্রা ও ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে সাগর হয়ে নৌপথে ঢাকায় আইস নিয়ে আসছিল চক্রটি। পরে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইসের চালান পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল চক্রটির। বিশাল অঙ্কের মাদকের লেনদেন কীভাবে হয় জানতে চাইলে র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার বাকিতে দেশীয় মাদক কারবারিদের আইস দিচ্ছে। আইসের চালান দেশে বিক্রি হওয়ার পর হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে টাকা যাচ্ছে। আবার অনেক সময় হাতে হাতে টাকা মিয়ানমারে যাচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা মিয়ানমারের মাদক চক্রের যোগসাজশে দেশে অবৈধ আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত। এই চক্রটি দেশে জসিমের নেতৃত্বে কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এই চক্রে ১২-১৫ জন সদস্য রয়েছেন। চক্রটি তাদের কার্যক্রম মূলত সোনাদিয়া থেকে পরিচালনা করতেন। তারা মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা সংগ্রহ করে সোনাদিয়া হয়ে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় নানা কৌশলে চালান দিতেন। চক্রটি মূলত নৌপথ ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে এই মাদক দেশে নিয়ে আসতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য চক্রটি নৌপথকে বেছে নেয়।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, চক্রের সদস্যরা মূলত মিয়ানমার থেকে দেশে আইস ও ইয়াবা সাগর পথে পাচার করতেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা এই চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করতেন। সাগর পথে মাদকের চালান গ্রহণ ও নিরাপদ স্থলে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে (২০/২৫ দিন) জেলেদের ছদ্মবেশ নিয়ে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করতেন। মালামাল গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসতেন। পরে ইয়াবা ও আইসের চালান সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়াতে আইস ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন। হাতিয়া থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া/ঢাকার আশেপাশে অথবা সুবিধাজনক স্থানে আইস পৌঁছাত চক্রটি। ঢাকা ছাড়াও বরিশাল, পটুয়াখালী ইত্যাদি অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতেন। মাদকের চালান মুন্সিগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র আইস ও ইয়াবার চালান গ্রহণ করে এবং সড়কপথে বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন।
তিনি বলেন, চক্রটির নেতা জসিম দীর্ঘ ৫-৭ বছর ধরে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তিনি লবণ ব্যবসার আড়ালে আইসের কারবারে জড়িত। তিনি মূলত মিয়ানমারের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় করতেন। জসিমের নেতৃত্বে চক্রটি প্রথমে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসতেন। সম্প্রতি রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর থেকে তারা মিয়ানমার থেকে আইস নিয়ে আসা শুরু করেন। এছাড়া জসিম রাজধানী থেকে কয়েকটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন।
মিয়ানমার থেকে আইস সংগ্রহ করার সময় দেশীয় মাদক কারবারিরা কীভাবে তাদের টাকা দেয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইস বা মাদক নিয়ে আসার সময় মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের দেশীয় কারবারিদের প্রাথমিকভাবে সব টাকা দিতে হয় না। নিয়ে আসা আইস বিক্রি হয়ে গেলে পরে হুন্ডি বা হাতে হাতে মিয়ানমারের মাদক কারবারিদের টাকা দেওয়া হয়।
মিয়ানমার বাকিতে মাদক দিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ অর্থের বিনিময়ে না, ২০-৩০ শতাংশ অর্থের মাধ্যমে তারা মাদক দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গ্রাম আইসের দাম দেশে ২৫-৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। একই পরিমাণ আইস ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে কিনে নিয়ে আসে। সেই অর্থে ২০ শতাংশ খুব বেশি বড় অঙ্কের টাকা না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল যে ঢাকা থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইস পাঠানো হতো। কিন্তু আমরা এখন দেখেছি, হাতিয়া থেকে নৌপথ ব্যবহার করে মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঢাকায় আইস আসছে। আবার হাতিয়া থেকে নৌপথে বরিশাল ও পটুয়াখালী পর্যন্ত আইস যাচ্ছে।
সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ঢাকায় মাদক আসছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নানা কৌশলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মাদক নিয়ে আসছে। বেশি লাভের আশা তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিয়ে আসছে। মাদকসেবীদের সংখ্যা না কমাতে পারলে কোনো না কোনোভাবে মাদক দেশে আসবে। এ ক্ষেত্রে নানা কৌশল নিয়ে মাদক নিয়ে আসবে। সমুদ্র পথে হাজার হাজার নৌকা মাছ ধরে। এর মধ্যে মাদক বহনকারী একটি নৌকাকে শনাক্ত করা কিছুটা কঠিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন