শিশুরা জান্নাতের ফুল। শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমাদের স্বপ্ন তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে। পারিবারিক শান্তি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাই শিশুদের মেধা বিকাশে ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবিধান খুবই জরুরি। প্রতিটি মানুষই বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পর সন্তান কামনা করেন। অধিকাংশ দম্পতিই হন সন্তানের গর্বিত বাবা-মা। এক্ষেত্রে শুধু সন্তান জন্ম দিয়ে বাবা-মা হওয়াই যথেষ্ট নয়। সবাইকে হতে হবে দায়িত্বশীল বাবা বা মা। অন্যথায় দুনিয়ায় যেমন রয়েছে ভোগান্তি, আখেরাতেও রয়েছে তেমনি অশান্তি এবং অপেক্ষমাণ নিশ্চিদ্র জবাবদিহিতা। কারণ সন্তান হলো বাবা-মায়ের কাছে প্রদত্ত আল্লাহর আমানত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল, তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের (তার সম্পদ ও সন্তানের); সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এককথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে।’ (বোখারি : ৭১৩৮)।
অনেক বাবা-মাই হয়তো বলবেন, কে বলেছে আমরা নিজ সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্ববান নই, ছেলেমেয়েদের প্রতি নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক নই? উত্তরে বলা হবে, আমরা বেখবর নই বটে; তবে যথাযথ দায়িত্ববান নই আমরা। আরও বাস্তব কথা হলো, আমরা নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল নই। কেউ হয়তো প্রিয় এ সন্তানদের স্রষ্টা আল্লাহর হুকুম মতো জীবন পরিচালনা করি না আর যারা করি, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে অবগতই নই। তাই দেখা যায়, আমরা শুধু সন্তানের দৈহিক চাহিদার তত্ত্বাবধান করি। তার আত্মিক চাহিদার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করি না। অথচ এর গুরুত্ব প্রথমোক্তটির চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। দৈহিক চাহিদাকে পরিতৃপ্তি দিতে পারে শুধু আত্মা। পক্ষান্তরে দৈহিক চাহিদার অপূর্ণতা সত্ত্বেও আত্মা পারে সুখী হতে। ইসলাম তাই শিশুর উভয় চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। বাবা-মাকে উভয় দিক তত্ত্বাবধান করতে নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছে।
সন্তানকে আত্মিকভাবে ঋব্ধ ও ঔশ্বর্যমন্ডিত করার ইঙ্গিত পাই আমরা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সূরা তাহরিম : ৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আলী (রা.) বলেন, ‘অর্থাৎ তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং ইলম শেখাও।’ (তাফসির ইবনে কাসির, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। এদিকে বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় তথা নৈতিক শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে তাদের সালাতের নির্দেশ দাও, তাদের বয়স দশ বছর হলে এজন্য তাদের শাসন করো এবং তাদের পরস্পরে বিছানা পৃথক করে দাও।’ (আবু দাউদ : ৪৯৫)।
প্রখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘জেনে রাখ, শিশু লালন-পদ্ধতি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছে আমানতস্বরূপ। তার পবিত্র অন্তর আধার, যা কোনো নকশা বা ছবি থেকে মুক্ত। ফলে তা যে-কোনো নকশা গ্রহণে প্রস্তুত এবং তাকে যার প্রতিই ধাবিত করা হবে, সে দিকেই ধাবিত হয়। তাই তাকে ভালোয় অভ্যস্ত করা হলে, সুশিক্ষায় প্রতিপালন করলে, সেভাবেই সে গড়ে উঠবে। ইহকালে ও পরকালে সে সুখী হবে। তার নেকিতে তার বাবা-মা এবং তার প্রত্যেক শিক্ষক ও শিষ্টাচারদানকারীই অংশীদার হবেন। পক্ষান্তরে তাকে খারাপে অভ্যস্ত করা হলে, তার সুশিক্ষায় অবহেলা করা হলে, সে হবে হতভাগ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এর দায় বর্তাবে তার কর্তা ও অভিভাবকের ওপর।’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/৬২)।
বুদ্ধি বিকাশের শুরুতে... প্রত্যেক বাবা-মা নিজ সন্তানকে শিষ্টাচারসম্পন্ন, সভ্য ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী বানাবে এবং তাকে অসৎ সঙ্গ থেকে বিরত রাখবে। তার মাঝে বুদ্ধির উন্মেষ লক্ষ করা মাত্র উত্তমরূপে তাকে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করতে শুরু করবে। বুদ্ধির এ উন্মেষের সূচনা লাজুকতার প্রাথমিক প্রকাশের মাধ্যমে। কারণ যখন সে লজ্জা পায়, সলাজ হয় এবং কোনো কিছু বর্জন করে, তা শুধু তার ওপর জ্ঞানের আলো পড়ার কারণেই করে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এটি তার জন্য একটি উপহার এবং সুসংবাদতুল্য, যা স্বভাবের সুস্থতা ও হৃদয়ের স্বচ্ছতা প্রমাণ করে। এটি পরিণত বয়সে তার বুদ্ধির পূর্ণতারও ইঙ্গিত প্রদান করে।
শিশুর লজ্জা-সংকোচ শিশুর জন্মগত লাজুকতার সুন্দর পরিচর্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাকে সুশিক্ষিত ও মার্জিতভাবে গড়ে তুলতে এ লাজুকতা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো উচিত। প্রতিপালনের প্রাথমিক অবস্থায় যদি শিশুর প্রতি অযত্ন ও অনাদর দেখানো হয়, তবে প্রায় ক্ষেত্রেই সে অসৎ স্বভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। মিথ্যুক, হিংসুক, নিন্দুক ও তস্কর হিসেবে এবং অনর্থক কথা, অট্টহাসি, কূটচাল ও অশ্লীল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে বড় হয়। শিশুকে এসব বদ অভ্যাস থেকে বাঁচানো সম্ভব আদব ও শিষ্টাচার শেখানোর মাধ্যমে। তাকে পাঠাতে হবে দ্বীনি শিক্ষালয়ে। সেখানে সে কোরআন ও হাদিস শিখবে। পূর্বসূরি বুজুর্গ ও মনীষীদের শিক্ষণীয় ঘটনা ও জীবনালেখ্য সম্পর্কে জানবে। এতে তার কচি মনে নেককার ও মনীষীদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জন্ম নেবে।
শিশুকে পুরস্কার-তিরস্কার শিশুর কোনো সুন্দর আচরণ বা প্রশংসনীয় কাজ চোখে পড়লে, তার প্রশংসা করতে হবে। তাকে খুশি করার মতো কিছু পুরস্কার দিতে হবে। মানুষের সামনে করতে হবে তার প্রশংসা। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যখন সে কিছু করবে প্রথমবারের মতো, তখন তা উপেক্ষা করতে হবে। গোপন রাখতে হবে; অন্যের সামনে প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষ করে বাচ্চাটিই যখন চাইবে সেটিকে গোপন রাখতে। অন্যের কাছ থেকে আড়াল করতে। যদি দ্বিতীয়বার এ কাজের পুনরাবৃত্তি করে, তবে তাকে গোপনেই শাসাতে হবে। বলে দিতে হবে, এমন কাজ তুমি দ্বিতীয়বার করা থেকে বিরত থাকবে। অন্যথায় মানুষের সামনে তোমাকে লজ্জা দেওয়া হবে। তাকে শাসন করার সময় কখনও অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এতে তার পক্ষে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার শোনা এবং মন্দ বিশেষণ হজম করা সহনীয় হয়ে উঠবে। তার অন্তরে কথার প্রভাব হ্রাস পাবে। তার হৃদয়ে কথার প্রভাব যে-কোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে। তাকে শুধু মাঝেমধ্যেই ভর্ৎসনা করা যাবে। মা তাকে বাবার ভয় দেখাবেন। মন্দকাজ থেকে ধমকাবেন।
পরিশ্রম করতে শেখান বাচ্চাকে দিনের কিছু সময় হাঁটাচলা ও খেলাধুলায় অভ্যস্ত করবেন। তাকে যাতে অলসতা না পেয়ে বসে। বাবা-মায়ের কিছু নিয়ে তাকে সঙ্গী-সাথি বা বন্ধুবান্ধবের সামনে বড়াই করতে নিষেধ করবেন। তাকে বরং বিনয়, ওঠাবসার সাথিদের সম্মান এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় কোমলতার স্বভাবে গড়ে তুলবেন।
তাকে শেখাবেন ত্যাগেই সম্মান; গ্রহণে নয়। মানুষের জিনিস নেওয়া নিন্দনীয়। তা এমনকি নিচুতা ও হীনতার পরিচায়ক। যদি গরিব ঘরের সন্তান হয় তবে তাকে শেখাতে হবে পরের জিনিস নেওয়া এবং পরের সম্পদে লোভ করা অবমাননা ও লাঞ্ছনাকর। শুনতে খারাপ লাগলেও তা মূলত সারমেয় স্বভাব। কুকুরের স্বভাব, মাত্র একটি লোকমার অপেক্ষায় পর দুয়ারে সে জিহ্বা নাড়াতে থাকে। তাকে আরও অভ্যস্ত করান য় যাতে সে সবার সামনে থুতু না ফেলে। অন্যদের উপস্থিতিতে হাই না তোলে। য় অন্যদের দিকে পিঠ দিয়ে না বসে। য় কারও পায়ের ওপর নিজের পা না রাখে। য় থুতনির নিচে হাতের তালু না রাখে এবং কাঁধে হেলান দিয়ে মাথা না রাখে। কারণ তা অলসতার আলামত। তাকে আদব শিক্ষা দেবেন। য় সে যেন বেশি কথা বলা থেকে বিরত থাকে। এটি যে এক দোষণীয় স্বভাব তা-ও তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
কথা সত্য হোক বা মিথ্যা, তা নিয়ে যে মাথা ছুঁয়ে কসম না করে। য় শিশুকে আরও নিষেধ করবেন বড়দের সামনে কথার সূচনা করতে। য় অভ্যস্ত করবেন সে যেন তাদের প্রশ্নের শুধু জবাব দেয়। যতটুকু জিজ্ঞেস করা হয় শুধু ততটুকু বলে। তারা কথা বললে মনোযোগসহ শোনে। য় বড় কেউ এলে তার সম্মানে উঠে জায়গা খালি করে দেয়। তাদের সামনে যেন না বসে। তাকে আরও বিরত রাখবেন বাজে কথা ও অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ থেকে। অন্যকে গালমন্দ করা ও অভিশাপ দেওয়া থেকে। যার মুখ থেকে হরদম গালি উচ্চারিত হয়, তার সঙ্গ ত্যাগ করতে বলবেন। কারণ তা খারাপ সঙ্গীদের থেকে তার মাঝে না ঢুকে পারে না। বাচ্চাদের আদব-কায়দাওয়ালা ও শিষ্ট-ভদ্র বানানোর প্রধান উপায়ই হলো তাকে কুসঙ্গ থেকে দূরে রাখা। তাকে বাবা-মা, শিক্ষক, গুরুজন এবং আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা সব মুরুব্বিকে মান্য করার আদব শেখাবেন। য় যখন সে ভালো-মন্দ বোঝার বয়সে উপনীত হবে, তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে অভ্যস্ত করে তুলবেন। য় রমজান মাসে যে কয়দিন পারে রোজা করতে নির্দেশ দেবেন। বলাবাহুল্য, পরিচর্যা যা করার প্রতিটি জিনিসের প্রাথমিক পর্যায়েই তা করতে হয়।
শিশুকে মূলত ভালো-মন্দ উভয় চরিত্রের মিশ্রণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার বাবা-মাই তাকে ভালো-মন্দের যে কোনোটির দিকে ধাবিত করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি শিশু (ইসলাম) ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা-মাই তাকে ইহুদি বানায়, খ্রিষ্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়।’ (বোখারি : ১২৯২)। অতএব আল্লাহর এ আমানত সম্পর্কে আমাদের সজাগ ও আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। সন্তানদের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক ও চারিত্রিক সুষ্ঠু বিকাশেও নজর দিতে হবে। শিশুর মনোদৈহিক উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা লাভের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুশিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। এতে মূল্যবোধ, সুকুমারবৃত্তি ও মানবিক গুণাবলির স্ফুরণ ঘটে। সভ্যতার উন্নয়নে বিশ্বনাগরিক সৃষ্টিতে শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীল ও যত্নবান হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন