নিত্যপণ্যের দাম দিনদিন বেড়েই চলেছে। যুদ্ধের কারণে আর্ন্তজাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে গত এক সপ্তাহে তেল, চাল, আটা, ময়দাসহ আরও অনেক পণ্যের দাম আবার বেড়েছে। বিশেষ করে ভোজ্য তেলের বাজারে দাম বাড়ার তেলেসমাতি চলছেই। অভিযোগ উঠেছে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেশে সয়াবিন তেলের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে তেলের দাম। এ ছাড়া চালের দামও আবার মান ভেদে কেজিতে ১ থেকে ২টাকা করে বেড়েছে। আটা, ময়দা, ছোলা এসব পণ্যের দামও কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া মাছ, মুরগী, ডিম এবং সবজির দামও আগের চেয়ে বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয় করতে না পেরে অনেকে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে ছেলে মেয়ের লেখা পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেক পরিবার আছে যারা এখন মাসে একবারও পরিবারের সদস্যদের পাতে মাছ-গোশত দিতে পারছে না।
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হচ্ছে না। ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানটি সব রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভোজ্যতেলের আমদানি ও রিফাইনের পরিমাণ জানতে চেয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, সব রিফাইনারি কোম্পানির কাছে ভোজ্যতেল বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তারা গত তিন মাসে কী পরিমাণ আমদানি করেছে, কত পরিমাণ রিফাইন (পরিশোধন) করেছে, তা কাস্টমস পেপারসহ চাওয়া হয়েছে। আগামী সোমবার পর্যন্ত তাদের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেলে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারা করছে, তা ধরা পড়বে। তথ্য পাওয়ার পর প্রতিটি রিফাইনারিতে ভোক্তা অধিকার অভিযান চালাবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে ৭ কারণে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এগুলো হলো- চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি, সরবরাহে ঘাটতি, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকা এবং দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা, আমদানি মূল্য, পরিবহন খরচ ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময়হারের ঊর্ধ্বগতি, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। গত ৩মার্চ এক সেমিনারে সংস্থাটি জানায়, সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস ফেব্রুয়ারিতে দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে হারের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছিলো তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রকৃত হার তার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক চাপে আছে। টিসিবির ট্রাকে মানুষের লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। সে সময় যখন বিবিএস জানিয়েছে মূল্যস্ফীতি উদ্বেগজনক নয়, তখন বিবিএসের তথ্য আমাদের ভাবায়।
চালের দাম আবার বেড়েছে। গত সপ্তাহে যে চাল ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে তা এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়। যে নাজিরশাইল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে তা এখন হচ্ছে ৭১ থেকে ৭২ টাকা কেজি। আটা এবং ময়দার দামও কেজিতে ৩টাকা বেড়েছে। ৭০ টাকা কেজি ছোলার দাম বেড়ে হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি।
সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে পেঁয়াজের দাম আবার ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় উঠেছে। এর সঙ্গে চড়াদামে বিক্রি হচ্ছে সবধরনের সবজি। বয়লার ডিম গত সপ্তাহে ১০০ থেকে ১০৫টাকা ডজন বিক্রি হলেও গতকাল তা ১২০ টাকা ডজন দরে বিক্রি হয়। তবে মাছ ও মুরগির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
সবজির বাজারে এখন সব থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বরবটি। এ সবজিটি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। কেজি একশ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে আরও দুটি সবজি। এর মধ্যে বাজারে নতুন আসা ঢেঁড়শের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। আর ভালো মানের করলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তবে নিম্নমানের করলা কোথাও কোথাও ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি পাওয়া যাচ্ছে।
খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী মো. শফিক বলেন, বাজারে অনেক খুঁজে বরবটি ও ঢেঁড়শ কিনেছি। আড়ত থেকেই আমাদের কেজি কেনা পড়েছে একশ টাকার ওপরে। ভালো মানের করলা বেশি দামে কেনা পড়েছে। এ কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আসলে কমদামে সবজি খাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে সবধরনের সবজির দাম বাড়ছে। ইতোমধ্যে ২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া টমেটোর কেজি ৬০ টাকা হয়েছে।
এদিকে গত সপ্তাহে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেঁয়াজের দাম বেড়ে এখন ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
পেঁয়াজের দামের বিষয়ে মালিবাগ হাজীপাড়ার ব্যবসায়ী মো. ফিরোজ বলেন, দুই সপ্তাহ আগে পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা হয়েছিল। মাঝে পেঁয়াজের দাম কমে ৪৫ টাকায় নামে। কিন্তু দুদিন ধরে পেঁয়াজের দাম আবার ৬০ টাকা হয়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার কারণে আমাদের এমন বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারিতে আমরাই পেঁয়াজের কেজি ৫৭ টাকা করে কিনেছি।
ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। শিমের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। শালগমের (ওলকপি) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। লাউয়ের পিস বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। লালশাকের আঁটি ১০ থেকে ১৫ টাকা, পালংশাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। গাজরের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। মুলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। কাঁচকলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এসব সবজির দামে পরিবর্তন আসেনি।
ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। আর সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৯০ থেকে ৩২০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির দামে পরিবর্তন আসেনি। গরুর গোশত গত সপ্তাহের মতো এ সপ্তাহেও ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে কাতল মাছ। শিং ও টাকি মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। শোলমাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা। তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। এককেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ছোট ইলিশ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। নলামাছ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ২০০ টাকা কেজি। চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি। সপ্তাহের ব্যবধানে মাছের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন