মানুষ দৃষ্টিহীন বলেই অন্ধ নয়, বরং মানুষ মূলত প্রজ্ঞাহীন হলেই অন্ধ হয়। পৃথিবীর এই ক্রান্তিকালে সবকিছু যখন থমকে গেছে তখনই আবার এসেছে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বই মেলা। চারদিকে নতুন মোড়কে নতুন বইয়ের পসরা সাজানো যেন অসংখ্য ফুটন্ত ফুলের বাগান। পাঠকের দল প্রজাপতির মতো উড়ে এসে নতুন বইয়ের পাতার উপর ভর করছে। শত শত বইয়ের বাগানের মাঝে একটু অন্যরকম আলোকিত ফুলের বাগান ‘স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা’। আর সকলের মতো ব্রেইল পাঠকেরাও খুঁজে নিচ্ছে তাদের প্রিয় বই ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় লেখকের অভিব্যক্তি একদম নিজস্ব অনুভূতিতে।
আজকাল শারিরীক প্রতিবন্ধকতার শিকার জনগোষ্ঠীকে ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সমাজের এসব মানুষ প্রতিবন্ধী নয় বরং পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারায় এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রতিবন্ধী বললে অত্যুক্তি হবে না। দৃষ্টিহীন মানুষদের মন সদা জাগ্রত, আলোকিত। সমাজের এ অংশের বইপ্রেমিদের কথা চিন্তা করে প্রতি বছরের মত এবারও অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাংলা একাডেমি অংশে স্টল বসিয়েছে ব্রেইল প্রকাশনী। এ উদ্যোগের ফলে পাঠ্যানুরাগী দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাচ্ছে খ্যাতিমান লেখকের লেখা কবিতা, উপন্যাস, ইতিহাস ও গল্পের বই পড়ার সুযোগ। গতকাল শনিবার মেলাপ্রাঙ্গণ সরেজমিনে দেখা যায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ব্রেইল প্রকাশনীতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বই পড়ার চমৎকার দৃশ্য। একাডেমি অংশে মেলা থেকে বের হওয়ার পথে হাতের ডান পাশে আলো ছড়াচ্ছে স্টলটি।
চোখে আলো না থাকলেও সব বাধা পেরিয়ে এখানে আলোর মিছিলে দৃষ্টিজয়ীরা আলোর পথযাত্রী। ব্রেইল পদ্ধতিতে পাতাজুড়ে ছয়টি করে বিন্দুর বিভিন্ন সংকেত থাকে। ঘর আকৃতির সংকেতগুলোতে হাত বুলিয়েই প্রাণের আলো মেলে কী লিখা তা ধরতে পারেন তারা। এর মাধ্যমেই সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্প-সাহিত্যে বিচরণ বরতে পারেন তারা। ফুটায় ফুটায় স্পর্শ করেই দৃষ্টিজয়ীরা অনর্গল পড়ে যাচ্ছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আর তা মুগ্ধচিত্তে দেখছেন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা। পুরো গ্রন্থমেলার চারদিকে যখন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, তখন তারাও ব্রেইল পদ্ধতির বই পেয়ে খুশি।
ব্রেইল প্রকাশনীর স্টলে কথা হয় দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থী নাজীমের সাথে। গাজীপুরের একটি স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র সে। পড়ছেন আশিক মুস্তাফা রচিত, ১৯৭১ বিচ্ছু বাহিনী বইটি। ইনকিলাবের সাথে স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে সব ধরনের লেখকের বই নিজেরা পড়তে পারি না। অন্যের মুখে বিভিন্ন লেখকের গল্প শুনি। নিজে নিজে বই পড়ার মজাই তো আলাদা! যেসব বই ব্রেইল আকারে প্রকাশ করে সেগুলোই নিজে পড়তে পারি। তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, যারা ভালো বই লিখেন তারা যদি আমাদের কথা চিন্তা করে ব্রেইল আকারে বই প্রকাশ করেন, তাহলে আমাদেরও নতুন বই পড়ার স্বাদ মিটতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিপি বলেন, অসংখ্য ধন্যবাদ নাজিয়া আপুকে যিনি এই অসাধারণ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছে। আমার অনেক ভালো লাগছে যে, আমি পড়তে পারছি হাতে ধরে ধরে। আপু ২০০৯ সাল থেকেই বিভিন্ন গল্পের বই নিয়ে আসছেন আমাদের জন্য, আমাদের ভীষণ ভালো লাগছে। হাতের স্পর্শে অনেক সুন্দর সুন্দর বই পড়ছি, এটা আসলেই অনেক আনন্দের। আমি খুব মনযোগ দিয়ে আসার পর থেকেই বই পড়ছি। ভীষণ ভালো লাগছে। কোন বইটি পড়ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসান আহমেদের লিখা ‘কোনোদিন জাগিবে না আর’ বইটি পড়ছি। ভবিষ্যতে কী হতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে মাস্টার্স-এ অধ্যয়ন বরছি এবং ভবিষ্যতে একজন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছে আছে আমার।
প্রতিটি প্রকাশনী থেকে ব্রেইল বের করার বাধ্যবাধকতা আরোপের কথা বলছেন এসব দৃষ্টিজয়ীরা। তারা বলছেন, ব্রেইল পদ্ধতিতে বই বের করা অনেক ব্যয়বহুল। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ব্রেইল বই নিয়ে যান এবং পড়া শেষ হলে পুনরায় তা ফেরত দেন। তাই ব্রেইল বইয়ের আরও স্টল থাকা দরকার। পাশাপাশি বাংলা একাডেমিকেও ব্রেইল বই বের করতে হবে। প্রত্যেক প্রকাশনী থেকে প্রতিবছর একটি হলেও ব্রেইল বই বের করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্পর্শ ব্রেইলের মূল উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীন ইনকিলাবকে বলেন, আমরা এবার ১০০তম ব্রেইল প্রকাশ করেছি। এটা আমদের জন্য একটা বড় পাওয়া যে আমরা এ পর্যায়ে পৈাঁছাতে পেরেছি। কারণ যখন আমরা এটা প্রকাশ করা শুরু করি তখন কিন্তু ভাবতে পারিনি যে আজকের এই জায়গায় আমরা আসতে পারব। আজকে মানুষ জানতে পারছে, বুঝতে পারছে যে ব্রেইল কী এবং দৃষ্টিজয়ীরাও পড়তে পারছেন তাদের পছন্দের বই, এটাও আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করে। লেখক প্রকাশক সবাই আমাদের সাথে আছেন এবং তারাও চান যে তাদের বই সবাই পড়ুক। শুধু যাদের দৃষ্টিশক্তি আছে তারা পড়বে এটা তো হতে পারে না। পৃথিবীর অনেক দেশে একটা নিয়ম আছে যে, যেসব বই বের হবে সেসব বইয়ের একটা অডিও কপি এবং ব্রেইল কপি বে থাকবে। আমাদের দেশেও যদি এই নিয়ম করা যায় তাহলে অনেক ভালো হবে বলে মনে করেন নাজিয়া।
প্রসঙ্গত, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা দানের জন্য লুই ব্রেইল নামে এক ফরাসি একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যাকে ব্রেইল পদ্ধতি বলা হয়। এতে ছয়টি উঁচু বিন্দুকে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে অক্ষর, সংখ্যা প্রভৃতি প্রকাশ করা হয়। একটি বিশেষ ছিদ্রযুক্ত ধাতব পাত অথবা টাইপরাইটার ব্যবহার করে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা যায়। এটা আঙুলের স্পর্শ অনুভূতি ব্যবহার করে পড়তে হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন