বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ভালবাসা দিবস : ইসলাম কি বলে

প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : ‘ভালবাসা দিবস’কে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী উন্মাতাল হয়ে ওঠে। বাজার ছেয়ে যায় নানাবিধ উপহারে। পার্ক ও হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো সাজানো হয় নতুন সাজে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’কে ঘিরে পড়ে যায় সাজসাজ রব। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন ঐ অপসংস্কৃতির মাতাল ঢেউ লেগেছে। হৈ চৈ, উন্মাদনা, ঝলমলে উপহার সামগ্রী, প্রেমিক যুগলের চোখেমুখে থাকে বিরাট উত্তেজনা। হিংসা-হানাহানির যুগে ভালবাসার এই দিনকে! প্রেমিক যুগল তাই উপেক্ষা করে সব চোখ রাঙানি। বছরের এ দিনটিকে তারা বেছে নিয়েছে হৃদয়ের কথোকতার কলি ফোটাতে।

‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ইতিহাস প্রাচীন। এর সূচনা প্রায় ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র মধ্য দিয়ে। এর সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খ্রিস্টানদের মাঝেও প্রচলিত হয়। ভ্যালেনটাইন ডে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- ১. রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আমলের ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেনটাইন সম্রাটের খ্রিস্টধর্ম ত্যাগের আহবান প্রত্যাখ্যান করলে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ২. ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমকদের লেসিয়াস দেবীর পবিত্র দিন। এদিন তিনি দু’টি শিশুকে দুধ পান করিয়েছিলেন। যারা পরবর্তীতে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিল। ৩. ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমানদের বিবাহ দেবী ‘ইউনু’-এর বিবাহের পবিত্র দিন। ৪. রোম সম্রাট ক্লডিয়াস তার বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে গিয়ে যখন এতে বিবাহিত পুরুষদের অনাসক্ত দেখেন, তখন তিনি পুরুষদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন। কিন্তু জনৈক রোমান বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এটাকে প্রত্যাখ্যান করেন ও গোপনে বিয়ে করেন। সম্রাটের কানে এ সংবাদ গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। সেদিন থেকে দিনটি ভালবাসা দিবস হিসাবে কিংবা এ ধর্মযাজকের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এ দিনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উপহার বিনিময় হয়। উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি, ‘ইব সু াধষবহঃরহব’ (আমার ভ্যালেন্টাইন হও), প্রেমের কবিতা, গান, শ্লোক লেখা কার্ড প্রভৃতি। গ্রীটিং কার্ডে, উৎসব স্থলে অথবা অন্য স্থানে প্রেমদেব (ঈঁঢ়রফ)-এর ছবি বা মূর্তি স্থাপিত হয়। সেটা হল একটি ডানাওয়ালা শিশু, তার হাতে ধনুক এবং সে প্রেমিকার হৃদয়ের প্রতি তীর নিশান লাগিয়ে আছে। এ দিন স্কুলের ছাত্ররাও তাদের ক্লাসরুম সাজায় এবং অনুষ্ঠান করে।
এ দিন পালিত বিচিত্র অনুষ্ঠানাদির মধ্যে একটি হচ্ছে দু’জন শক্তিশালী পেশিবহুল যুবক গায়ে কুকুর ও ভেড়ার রক্ত মাখত। অতঃপর দুধ দিয়ে তা ধুয়ে ফেলার পর এ দু’জনকে সামনে নিয়ে বের করা হ’ত দীর্ঘ পদযাত্রা। এ দু’যুবকের হাতে চাবুক থাকত যা দিয়ে তারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে আঘাত করত। রোমক রমণীদের মাঝে কুসংস্কার ছিল যে, তারা যদি এ চাবুকের আঘাত গ্রহণ করে তবে তারা বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা এ মিছিলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করত। ১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ। এসব কার্ডে ভাল-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত। ১৮শ’ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যেসব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডেতে বিনিময় হত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত।
সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয় তা হল ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলনাকাঙ্ক্ষী অসংখ্য যুগলের সবচেয়ে বেশী সময় চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। আবার কোথাও কোথাও চুম্বনাবদ্ধ হয়ে ৫ মিনিট অতিবাহিত করে ঐ দিনের অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে। ভালবাসায় মাতোয়ারা থাকে ভালবাসা দিবসে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া- সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড়। ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে’ উপলক্ষে অনেক তরুণ দম্পতিও হাজির হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে। ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উদযাপন উপলক্ষে দেশের নামী-দামী হোটেলের বলরুমে বসে তারুণ্যের মিলন মেলা। ‘ভালবাসা দিবস’কে স্বাগত জানাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ বলরুমকে সাজান বর্ণাঢ্য সাজে। নানা রঙের বেলুন আর অসংখ্য ফুলে স্বপ্নিল করা হয় বলরুমের অভ্যন্তর। জম্পেশ অনুষ্ঠানের সূচিতে থাকে লাইভ ব্যান্ড কনসার্ট, ডেলিশাস ডিনার এবং উদ্যাম নাচ। আগতদের সিংহভাগই অংশ নেয় সে নাচে। ঘড়ির কাঁটা যখন গিয়ে ঠেকে রাত দু’টার ঘরে তখন শেষ হয় প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের ‘ভালবাসা দিবস’ বরণের অনুষ্ঠান। ঢাবির টিএসসি এলাকায় প্রতি বছর এ দিবসে বিকেল বেলা অনুষ্ঠিত হয় ভালবাসা র‌্যালি। এতে বেশ কিছু খ্যাতিমান দম্পতির সাথে প্রচুরসংখ্যক তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকা যোগ দেয়। প্রেমের কবিতা আবৃত্তি, প্রথম প্রেম, দাম্পত্য এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির স্মৃতি চারণে অংশ নেয় তারা।
আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়া-বুড়িরা পর্যন্ত নাচতে শুরু করে! তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসে ভালবাসা বিলাতে, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালবাসা নেই! আমাদের বাংলাদেশী ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুকরণে এ দিবস পালন করে, তাদের ভালবাসা জীবনজ্বালা আর জীবন জটিলতার নাম; মা-বাবা, ভাইবোন হারাবার নাম; নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত হওয়ার নাম। তাদের ভালবাসার পরিণতি ‘ধর ছাড়’ আর ‘ছাড় ধর’ নতুন নতুন সঙ্গী। তাদের এ ধরা-ছাড়ার বেলেল্লাপনা চলতে থাকে জীবনব্যাপী। বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে স্যাটেলাইটের কল্যাণে মুসলিম সমাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ করছে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্র্যকে ভুলে গিয়ে, ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে তারা আজকে প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের কর্মকা-ে মুসলিম জাতির উঁচু শির নত হচ্ছে। অথচ এটা বহুপূর্বে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করে গেছেন।
ছাহাবী আবু অকেদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) খায়বার যাত্রায় মূর্তিপূজকদের একটি গাছ অতিক্রম করলেন। তাদের নিকট যে গাছটির নাম ছিল ‘জাতু আনওয়াত’। এর উপর তীর টানিয়ে রাখা হ’ত। এ দেখে কতক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও এমন একটি ‘জাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। রাসূল (ছাঃ) ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, ‘সুবহানাল্লাহ, এ তো মূসা (আঃ)-এর জাতির মত কথা। আমাদের জন্য একজন প্রভু তৈরি করে দিন, তাদের প্রভুর ন্যায়। আমি নিশ্চিত, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমরা পূর্ববর্তীদের আচার-অনুষ্ঠানের অন্ধানুকরণ করবে’ (মিশকাত হা/৫৪০৮)। অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে’ (আবূ দাউদ হা/৪০৩১)।
মানুষের অন্তর যদিও অনুকরণপ্রিয়, তবুও মনে রাখতে হবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ বিচারে এটি গর্হিত, নিন্দিত। বিশেষ করে অনুকরণীয় বিষয় যদি হয় আক্বীদা, ইবাদত, ধর্মীয় আলামত বিরোধী, আর অনুকরণীয় ব্যক্তি যদি হয় বিধর্মী, বিজাতি। দুর্ভাগ্য যে, মুসলমানরা ক্রমশ ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসে দুর্বল হয়ে আসছে এবং বিজাতিদের অনুকরণ ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি আরম্ভ করছে। যার অন্যতম ১৪ ফেব্রুয়ারি বা ভালবাসা দিবস। মুসলমানদের জন্য এসব বিদস পালন জঘন্য অপরাধ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Mostofa kamal ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১১:০১ এএম says : 0
ধন্যবাদ ইনকিলাব কর্তৃপক্ষকে এমন সচেতনমূলক পোষ্টের জন্য।
Total Reply(0)
ওয়ালিউল ইসলাম রিজভী ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৮:২৮ এএম says : 0
অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই। এই সব সচেতনমুলক পোষ্ট আমাদের সকলের জন্য একান্ত জরুরী। আশা করি এই পোষ্ট পড়ার অনেকেই এই বেহায়াপনা থেকে ফিরে থাকবে।
Total Reply(0)
মানাজির ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৭:১৭ পিএম says : 0
সুন্দর তথ্যবহুল আলোচনা
Total Reply(0)
মুহাম্মদ মো'তাছিম বিল্লাহ ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১০:১২ পিএম says : 0
শুকরিয়া। আশা করি, ইনকিলাব সবসময় এ ধরনের সচেতনমূলক লেখা প্রকাশ করবে
Total Reply(0)
josim ২৫ এপ্রিল, ২০২১, ৭:৪৫ এএম says : 0
নিজের স্ত্রীর সাথে পালন করা যাবে না?
Total Reply(1)
মুয়াজ আল আবরার ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১১:৫৬ এএম says : 0
ভাইয়া ইহুদী খ্রিষ্টানদের কোন কাজের ধারের কাছেও যেতে মানা করা হয়েছে। সেখানে আপনি বলছেন স্ত্রীর সাথে পালন করবেন। এটা কিভাবে জায়েজ হয় ভাই? কাল কিয়ামতের দিন কি জান্নাতে যেতে চান না ভাবী কে নিয়ে? তাইলে এসব পশ্চিমা সংষ্কৃতিকে ফলো করা বাদ দেন। আসসালামু আলাইকুম।
মুফতি মুযযাম্মিল হুসাইন ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৩:০২ পিএম says : 0
মাশাআল্লাহ, ধন্যবাদ, ইনকিলাব কর্তৃপক্ষকে শরীয়াভিক্তিক চমৎকার পোস্ট করার জন্যে।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন