বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর একটি হলো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি।তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে।কিন্তু তিস্তা ইস্যুতে আশ্বাসে থেমে গেছে।১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির পর তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।–ডেইলি টাইমস, দ্য মুসলিম টাইমস
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফর করেন। সেসময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। অন্তর্বর্তী চুক্তির মেয়াদ ছিল ১৫ বছর। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের তিস্তার পানির ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে চুক্তি চূড়ান্ত হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এই সফর তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরের আশা জাগিয়েছিল। সফরকালে তিনি মমতা ব্যানার্জির সাথেও বৈঠক করেছিলেন। যদিও তখন তিনি রাজি হননি। তিনি বলেন, তার মতবিরোধের মূল কারণ উত্তরবঙ্গের মানুষকে বঞ্চিত করে তিনি বাংলাদেশকে পানি দিতে রাজি নন। এমনকি ২০১৫ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ঢাকা সফর করেছিলেন। সে সময় তিস্তা চুক্তি নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দেওয়া হলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদী রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ৪৩টি অভিন্ন নদীর বেশির ভাগ রয়েছে যা প্রতিবেশী দেশগুলির জন্য অন্যায্যতা প্রকাশ করছে।
৫৪টি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি কমিটি ৫-৬ জানুয়ারী ২০২১ দুইদিনের বৈঠক করেছে। সভাটি কার্যত করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অভিন্ন নদীতে পানি বণ্টনের জন্য একটি কাঠামো চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। এর আগে বাংলাদেশ সরকার ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে পানি সংকট মোকাবেলায় মানবিক কারণে ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি পাবে বলে সম্মত হয়েছিল। তবে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। একটি আন্তঃসীমান্ত নদী জুড়ে জল ভাগাভাগির ক্ষেত্রে চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এটি একটি দেশের পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছিল। তিস্তা নদীর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাতিস্তা প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শুধু তিস্তা উপকূল বা উত্তরবঙ্গের মানুষ নয়, সমগ্র বাংলাদেশ এর সুফল ভোগ করবে। পরিবর্তন আসবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জনজীবনে। চুক্তি সম্পন্ন না হলে সাব্রুম শহরে এমনকি বাংলাদেশেও পানির ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে না। আবার পাম্পহাউস দিয়ে সেচ প্রকল্প নির্মাণ করে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। চুক্তির ফলে উভয় দেশই লাভবান হবে।
গজলডোবা বাঁধটি নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে যায়। বাঁধের ৫৪টি গেট রয়েছে, যা তিস্তার মূলস্রোত থেকে বিভিন্ন সেক্টরে পানি সরানোর জন্য বন্ধ রয়েছে। বাঁধটি মূলত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা নদীতে প্রবাহিত করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। গজলডোবা বাঁধের আগে তিস্তা অববাহিকায় ২৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যেত, কিন্তু ভারত পানি প্রত্যাহার করায় এখন পানি প্রবাহ ৪০০ কিউসেক কম। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় ৬৫০০ কিউসেক, যা ২০০৬ সালে ১৩৪৮ কিউসেকে নেমে আসে এবং ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় মাত্র ৮০০ কিউসেক। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
পানির অভাবে অনেক জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ কৃষকরা লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে তাদের জীবন-জীবিকায়। অপর্যাপ্ত পানির প্রবাহে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে চরগুলোতে। গ্রীষ্মকালেও নদীতে পানি থাকে না। মানুষ পায়ে হেঁটে নদী পার হয়। মরা নদীতে পরিণত হয়েছে তিস্তা। এভাবে চলতে থাকলে শুধু জনজীবনই নয়, জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়বে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখন সময়ের দাবি। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারতের বিলম্বই বোঝায় যে, তারা এটা মানতে নারাজ। তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত তিস্তানদীর ১১৫ কিলোমিটার খনন করবে। খননের মাধ্যমে নদীর গভীরতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক নদী উদ্ধার করা হবে। নদীর তীরবর্তী জমি চাষের উপযোগী করা হবে। এমনকি তিস্তানদীর উভয়তীরে শিল্পনগরী গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা বহুমানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
মূলত তিস্তা নদীতে রাজি নয় ভারত।ভারতের মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে তার একটি বিশ্বস্ত মিত্র। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ অবশ্যই বিকল্প পথ খোঁজার চেষ্টা করবে। প্রায়ই বলা হয় যে, বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমানে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বর্ণযুগের সাক্ষী। বাংলাদেশ ইস্যুতে চীনের সহযোগিতা গ্রহণ করার আগে ভারতের উচিত বিরোধ নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা এখনও ভারতকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে। ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর বণ্টন সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। তবে ভারতের পক্ষ থেকে দেরি হলে বিকল্প পথের কথা ভাবতে পারে বাংলাদেশ।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পানিচুক্তি স্বাক্ষর করা দরকার। ভারতের উচিত নিজেদের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করা। তিস্তা সমস্যার একটি ফলপ্রসূ সমাধান শুধু বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত করবে না বরং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতেও সাহায্য করবে। তিস্তা চুক্তি ভারতকেও দারুণভাবে উপকৃত করবে। এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এগিয়ে গেলে তা বাংলাদেশের সকল স্টেকহোল্ডারদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে। তাই এবিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বর্ণযুগকে ভারতের সর্বোত্তম স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাতিস্তা প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শুধু তিস্তা উপকূল বা উত্তরবঙ্গের মানুষ নয়, সমগ্র বাংলাদেশ এর সুফল ভোগ করবে। পরিবর্তন আসবে উত্তরবঙ্গের জনজীবনে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন