মৃত্যু উপত্যকায় দুঃসহ স্মৃতি ‘দেশবাসীর দোয়ায় আমরা ফিরে আসতে পেরেছি’
যাওয়ার সময় ২৯ জন গিয়েছিলেন একসঙ্গে। তুলেছিলেন তারা দলবদ্ধ ছবিও। সেই ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান। কে জানত, তার এই ছবিই হবে সহকর্মীদের সঙ্গে শেষ ছবি! হাদিসুরকে রেখেই গতকাল বুধবার মৃত্যু উপত্যকা ইউক্রেন ছেড়ে দেশে ফিরেছেন ২৮ নাবিক। বিমানবন্দরে সিক্ত হলেন তারা স্বজনদের আনন্দ অশ্রতে।
কিন্তু এ আনন্দ আরও দুঃখ বাড়িয়েছে হাদিসুরের পরিবারের মাঝে। সবারই প্রত্যাবর্তন অক্ষত অবস্থায়। শুধু লাশ হয়ে দূরদেশে পড়ে রইলেন হাদিসুর। তার লাশ দেশে আনতে আরও সপ্তাহখানেক লাগতে পারে; বলছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল দুপুর ১টার কিছু আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিআইপি গেটে এসে পৌঁছান হাদিসুরের ভাই প্রিন্স। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর ভাই, ভাই বলে চিৎকার করতে থাকেন তিনি। এক পর্যায়ে কণ্ঠ ভেঙে আসে তার। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন প্রিন্স। বেশ কিছুটা সময় ভাই, ভাই বলে মেঝেতে গড়াগড়ি করতে থাকেন প্রিন্স। পরে তিনি উঠে দাঁড়ান। আবার ভাই, ভাই বলে চিৎকার করতে থাকেন। এসময় বিমানবন্দরে উপস্থিত সবার মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকের চোখ ভিজে যায় হাদিসুরের ভাইয়ের কান্নায়।
প্রিন্স বলেন, আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি আমার ভাই (লাশ) আসবে। আমার ভাই, কখন আসবে সেটা জানতে চাচ্ছি। কিন্তু তারা কিছুই বলছে না। প্রিন্স যেখানে কান্নাকাটি করছিলেন তার একটু সামনে গেটের বাইরে নিহত নাবিক হাদিসুরের বাবা-মাও কান্নাকাটি করছিলেন। হাদিসুরের বাবা একবার মেঝেতে পড়ে যান। তিনিও আহাজারি করতে থাকেন ‘আমার ছেলেরে আইনা দাও, আইনা দাও’ বলে।
গত ২৪ ফেব্রæয়ারি থেকে ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। বাংলাদেশ সময় ২ মার্চ রাতে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে হামলার শিকার হয় জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’। এতে জাহাজটিতে থাকা ২৯ জন বাংলাদেশি নাবিকের একজন হাদিসুর নিহত হন। ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া ২৮ নাবিককে গতকাল দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। গতকাল দুপুরে তারা ঢাকা পৌঁছেন। নিহত ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের পরিবার ভেবেছিল এই ২৮ জনের সঙ্গে হাদিসুরের লাশও আসবে। সে জন্য তারা বিমানবন্দরে এসে অপেক্ষা করছিলেন।
জানা গেছে, রকেট হামলায় নিহত ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের লাশ ইউক্রেনের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে হিমাগারে রাখা হয়েছে এবং পরে সুবিধাজনক সময়ে সেটি দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। গতকাল হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউক্রেন থেকে রোমানিয়া হয়ে ২৮ নাবিকের দেশে প্রত্যাবর্তনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ইউরোপ ও সিআইএস অনুবিভাগের মহাপরিচালক শিকদার বদিরুজ্জামান।
বদিরুজ্জামান বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আমাদের ২৮ জন ক্রুকে উদ্ধার করতে পেরেছি। পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও অস্ট্রিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সর্বোপরি সরকারের সহযোগিতায় তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, হাদিসুরের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। তার দেহাবশেষ অতিসত্বর দেশে নিয়ে আসব। কবে নাগাদ নিয়ে আসা হবে জানতে চাইলে বদিরুজ্জামান বলেন, যত দ্রæত সম্ভব। এটার সময় ফিক্সড করে বলা যাবে না। একটা দেশে যুদ্ধ চলছে, সেখানে মানুষ ঢুকতে পারছে না। আমাদের আন্তরিকতা শতভাগ আছে। আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা সবই আছে।
হাদিসুরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে বদিরুজ্জামান বলেন, আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল এ ২৮ জনকে উদ্ধার করা। তারপর আমাদের যা করণীয় থাকবে তার সবই আমরা করব। তাদের জন্য যতটুকু করণীয় সেটা আমরা করব। সরকারের তরফ থেকে যতটুকু করার সেটা করব। দেশে প্রত্যাবর্তন করা ২৮ নাবিকের বিষয়ে তিনি বলেন, উদ্ধার ২৮ জন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। তবে তারা ট্রমাটাউজড। তাদের মেডিকেল টেস্টসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। শারীরিক পরীক্ষা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২৮ জনকে তাদের পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হবে।
এদিকে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে সাংবাদিকদের কথা বলেছেন ফিরে আসা নাবিকরা। রুশ সেনা অভিযানের মুখে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আটকে পড়া ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের মাস্টার জি এম নূরে আলম বলেন, অনেক বড় বড় দেশের ক্রুরা সেখানে আটকা আছেন। আমরা সকলেই আনন্দিত সুস্থভাবে দেশ ফিরতে পেরেছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ও পোল্যান্ড, রোমানিয়ায়, অস্ট্রিয়ার দূতাবাস কঠোর পরিশ্রম করেন। আমরা এত দ্রæত দেশে ফিরতে পারবো কিনা তা ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়।
তিনি বলেন, অত্যন্ত গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি আমাদের কলিগ ও থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের মৃত্যুতে। তার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা তার লাশ হিমঘরে রেখে এসেছি।
ইউক্রেনে বাংলাদেশি জাহাজে হামলার ঘটনায় প্রসঙ্গে জি এম নূরে আলম বলেন, আমরা নিয়মিত ডিউটিতে ছিলাম। বিকেলে যখন আ্যটাক হয়, তখন জাহাজের ব্রিজে আগুন লেগে গিয়েছিল। এরপর আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। দেশবাসী আমাদের জন্য অনেক দোয়া করেছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে বিভিন্ন পরামর্শ ও সাহস দিয়েছেন। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও ফোন করে আমাদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেন। আমরা যেখানে দেখেছি প্রায় ৬০ কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে রিফিউজিরা সীমান্ত অতিক্রম করছে। কিন্তু আমাদের হেঁটে পার হতে হয়নি। যেদিন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়, সেদিন সকাল থেকেই চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না বলেও জানান জাহাজের মাস্টার।
এদিকে দেশে ফেরা ২৮ নাবিকের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, গত ২ মার্চ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ ইউক্রেনের ওলভিয়া বিমানবন্দরে অবস্থানকালে রাশিয়ার সেনা অভিযানের শিকার হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরপত্তার স্বার্থে ওই জাহাজে কর্মরত ২৮ জন নাবিককে সরকারের চেষ্টায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
তালিকায় থাকা ২৮ নাবিক হলেন- জি এম নুর ই আলম, মো. মনসুরুল ইসলাম খান, সেলিম মিয়া, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, মো. রোকনুজ্জামান রাজীব, ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি, ফয়সাল আহমেদ সেতু, মো. ওমর ফারুক, সৈয়দ আশিফুল ইসলাম, রাজীবুল আউয়াল, সালমান সরওয়ার সামি, ফারজানা ইসলাম মৌ, মো. শেখ সাদী, মো. মাসুদুর রহমান, মো. জামাল হোসাইন, মোহাম্মদ হানিফ, মো. আমিনুর ইসলাম, মো. মোহিন উদ্দিন, হোসাইন মোহাম্মদ রাকিব, সাজ্জাদ ইবনে আলম, নাজমুল উদ্দিন, মো. নজরুল ইসলাম, সারওয়ার হোসাইন, মো. মাসুম বিল্লাহ, মোহাম্মদ হোসাইন, মো. আতিকুর রহমান, মো. শফিকুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ ডেনিশ কোম্পানি ডেল্টা করপোরেশনের অধীনে ভাড়ায় চলছিল। মুম্বাই থেকে তুরস্ক হয়ে জাহাজটি গত ২২ ফেব্রæয়ারি ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে নোঙর করে। ওলভিয়া থেকে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে ২৪ ফেব্রæয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল জাহাজটির।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন