মফিজুর রহমান পেশায় বেসরকারি চাকুরে। বেতন সর্বসাকল্যে পান ৫০ হাজার। এর ভেতর তিন বেডের বাসাভাড়া, গ্যাস, মোবাইল, ইন্টারনেট, ইলেকট্রনিক বিলসহ ৩০ হাজার চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে ৫ জনের একটি পরিবারের ৩০ দিনের খাদ্য, দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা খরচ, সাংসারিক অন্যান্য খরচ, নিয়মিত হাতখরচ, প্রতিদিনের যাতায়াত ভাড়া মেটাতে মাস শেষে ধারদেনা করে চলতে হয়। করোনার সময় গ্রামের জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। এখন চাকরি করে নিয়মিত বেতন পেলেও প্রতিটি পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সামাজিক কারণে নিজে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। স্ত্রীকে বোরকা পড়িয়ে শনিরআখড়ায় ধনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে টিসিবির ট্রাকের সামনের লাইনে দ্বার করিয়েছিলেন। কিন্তু দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর পণ্য না পেয়ে ফেরত এসেছেন। মফিজুর রহমান দুঃখ করে বললেন, মন্ত্রীরা দাবি করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিনগুণ বেড়েছে। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীদের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়, মানুষের ক্রমক্ষমতা বেড়েছে না কমেছে। ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে সংসার চালাতে পারছি না; যারা আমার চেয়ে কম বেতনে চাকরি করেন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার চালান তারা কি অবস্থায় আছেন?
রাজধানীর গুলশানের ভাটারা এলাকায় রিকশার মিস্ত্রী মো. হারুন জানালেন, প্রতিমাসে ১০ থেকে ১৫ দিন পর কমদামের তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছ ক্রয় করেন। ৩শ’ থেকে ৬শ’ টাকা প্রতিদিন আয় করেন। স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে ২ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তার স্ত্রী একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, তারা প্রতিদিনই শাক দিয়ে ভাত খান। বাজারে সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় মাসে এক থেকে দুই দিন সবজি রান্না করেন। তিনি বলেন, পণ্যমূল্যের কারণে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, ছেলেকে লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।
মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন পাওয়া মফিজুর রহমান ও গুলশানের রিকশার মিস্ত্রি হারুন যেন দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের প্রতিচ্ছবি। কোনো কোনো পরিবারের কর্তা আমিষের চাহিদা মেটাতে রাতে ফার্মের মুরগির গিলা-কলিজা, চামড়া ক্রয় করেন ফুটপাথ থেকে। গতকার ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশের দেড় বছর বয়সি অজন্তার মা-বাবা সবসময় ওকে ডিম, শাক-সবজি ও ফলমূল এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে চায়। কিন্তু প্রায়ই আর্থিক সংকটের কারণে তা সম্ভব হয় না। করোনাভাইরাস মহামারি অনেক পরিবারকেই দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে; আবার পণ্যের মূল্য বেড়েছে, যার ফলে শিশুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি শিশুদের এ পুষ্টি সংকট মোকাবিলায় পুষ্টিকর খাবার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে তুলতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহŸান জানিয়েছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী পাইকারি বাজারের পাশে কুতুবখালি ফুটপাথে বা ভ্যান গাড়িতে করে শাক-সবজি ও মাছ বিক্রি করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। বিক্রেতাদের দোকান ভাড়া, পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ কম থাকায় বাজারের থেকে কিছুটা কম দামে পণ্য বিক্রি করেন। আগে এসব ফুটপাথের দোকানে নিম্নশ্রেণির মানুষদের বেশি দেখা যেত। এখন মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তদেরও এসব বাজারগুলোতে দেখা যাচ্ছে। গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা গেল পাইকারি মাছ ও কাঁচাবাজারের পাশাপাশি কুতুবখালি বাজারের পূর্ব মাথায় ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজি ও মাছ। মাত্র কয়েকশ’ মিটারের দূরত্বে এখানে জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক কম। ফুটপাথে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির পসরা সাজিয়ে বসেছে ক্ষুদ্র বিক্রেতারা। এছাড়াও মহিলারা পেঁয়াজ, আদা, আধাপচা বেগুন, শাক, রসুনের ভাগা সাজিয়ে বসেছে। যা প্রতি ভাগা বিক্রি করা হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ টাকায়। বিক্রেতারা জানালেন, আগে রিকশাওয়ালা, মুটে কুলিরা এখন থেকে পণ্য ক্রয় করতেন। এখন নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের অনেকেই পণ্য কিনছেন। এখানে বাজার করতে আসা আনোয়ার আলি বলেন, বাজারে সব কিছুরই তো এখন দাম বেশি। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি। শাক-সবজি ও মাছ অন্য বাজারের থেকে এখানে দাম কিছুটা কম। পণ্যের মান একটু খারাপ হলেও এখান থেকেই নিয়মিত বাজার করি। এক নারী ক্রেতা বলেন, জিনিসপত্রের যে হারে দাম বাড়ছে আমাদের মতো মানুষদের দিন পার করা কষ্টকর হয়ে গেছে। যেখানে দুই পয়সা কমে পাই, সেখান থেকে বাজার করি। সামনে রমজান মাস। আল্লাহ জানেন, পণ্যমূল্যের কি অবস্থা হবে।
রাজধানীর মিরহাজিরবাগ এলাকার ফুটপাথেও সকালে এ ধরনের বাজার বসতে দেখা যায়। সেখানেও বড় বাজারগুলো থেকে তুলনামূলক কম দামে বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজি ও মাছ। যাত্রাবাড়ির ফারুক সড়কের মূল কাঁচাবাজারে একটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, পাকা টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। শালগমের (ওল কপি) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। লাউ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। লালশাকের আঁটি ১৫ টাকা, পালংশাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা। অথচ মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরে মিরহাজিরবাগ ফুটপাথে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, পাকা টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। শিম কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। লাউ প্রতি পিস ৩০ থেকে ৪০ টাকা। লালশাকের আঁটি ১০ টাকা, পালংশাক হচ্ছে ১০ টাকায় আঁটি, দুই আঁটি একসঙ্গে নিলে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সংসার আর চলছেই না। যে বেতনে চাকরি করেন তাতে ১৫ দিনের বাজার খরচ হয় না। শহীদুল্লাহ নামের একজন জানালেন, বাসভাড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। বেতন বাড়েনি, আয় বাড়েনি; অথচ খরচ বেড়েছে। রমজান মাসে এভাবে পণ্যমূল্য বাড়লে ইফতার চিহারির ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মূলত নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেই না। কয়েকদিন পর পবিত্র রমজান শুরু হবে। তার আগেই বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যে যেন আগুন লেগেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রধানের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কয়েকজন মন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য এবং লাগাম ছাড়া কথাবার্তায় ব্যবসায়ীরা পণ্যের মূল্য কমাচ্ছে না। বরং প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেই ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষ এখন নিঃসন্দেহে অনেক সমস্যায় পড়ে গেছে। তাদের আয় বাড়েনি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। সরকারের উচিত মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানো। সরকারের হিসাব বলছে, আমাদের গড় আয় নাকি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষ তাদের আয় বাড়ছে বলে তো আমরা দেখছি না। তাই সরকারের উচিত সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা। তা না হলে সরকারের সব বড় বড় অর্জন মøান হয়ে যাবে।
টিসিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে খোলা পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, দারুচিনি, ধনিয়ার দাম বেড়েছে। সংস্থাটি তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে খোলা পাম অয়েলের দাম দশমিক ৩২ শতাংশ, মসুর ডালে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ছোলায় ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আলুতে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, আমদানি করা পেঁয়াজে ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, দেশি রসুনে ২২ দশমিক ২২ শতাংশ, আমদানি করা রসুনে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, দেশি শুকনা মরিচের ৬ দশমিক শ‚ন্য ৬ শতাংশ, আমদানি করা শুকনা মরিচে ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, আমদানি করা হলুদে ৩ দশমিক শ‚ন্য ৩ শতাংশ, দেশি আদার ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, দারুচিনির ২ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং ধনিয়ার ৮ শতাংশ দাম বেড়েছে।
রমজানে পণ্যমূল্য যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে সে লক্ষ্যে ১০ মার্চ সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি রমজানের চাহিদা মেটাতে ১ কোটি ৭১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫২ লিটার সয়াবিন তেল, ১৪ হাজার টন চিনি, ১০ হাজার টন ছোলা এবং ১৯ হাজার ৫০০ টন মসুর ডাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯১ কোটি ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৬ টাকা। শুধু তাই নয়Ñ ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলা আমদানির ওপর ভ্যাট তুলে নেয়া হয়েছে। তারপরও বাজারে এসব পণ্যের দাম কমছে না। এমনকি ভোজ্যতেল বাজারে ছাড়তে বিষয়ে ঢাকঢোল পিঠিয়ে প্রচারণা চালানো হলেও এখনো বাজারে ভোজ্যতেলের সঙ্কট রয়েই গেছে।
গতকাল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এবং একটি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করার জন্য দেশের ভেতরে-বাইরে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। রমজান মাস সন্নিকটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গত কয়েক বছর করোনা সংক্রমণ থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারসহ আমাদের দেশেও দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। একশ্রেণির মুনাফাখোর, সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে উসকে দিচ্ছে। মানুষের দুঃখ, কষ্ট যাতে বৃদ্ধি পায়, সেজন্য তারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। দ্রব্য মূল্যসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য যাতে বৃদ্ধি পায়, সেজন্য তারা এসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করছে।
এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে লোকসানে পড়ে অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির ৩৪তম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় এমন তথ্য জানানো হয়। সভায় বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, করোনার কারণে আমাদের যে লোকসান হয়েছে, সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি আমাদের থমকে দিয়েছে। বরং এখন পণ্যের দামের কারণে খাবার বিক্রি করে লোকসান গুণতে হচ্ছে। আমরা আর টিকতে পারছি না।
জানতে চাইলে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করতেই পারছে না। এ অবস্থায় জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের শুল্ক কর কমাতে হবে। উচ্চমূল্যের কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া যারা পণ্য কিনতে পারছেন না তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন