অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, রান্নায় অতিরিক্ত তেল ও মশলার ব্যবহার এবং খাদ্যে ভেজালের কারণে বাংলাদেশে ২০১৫ সাল থেকে বছরে ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে আলসারের ওষুধ বিক্রি। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৫ বছরে বহুল ব্যবহৃত এই ওষুধ বিক্রি করে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বার্ষিক প্রায় ৩ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা ব্যবসা করেছে। বার্ষিক বিক্রি বৃদ্ধির হিসাব অনুযায়ী এই বিক্রয় বর্তমানে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর পাশাপাশি বাড়ছে কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধের বিক্রি। ধ‚মপান এবং ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য কারণে দেশে কার্ডিয়াক রোগ বাড়ছে। এর সঙ্গে বার্ষিক ১৬ শতাংশ হারে বাড়ছে এই ওষুধের বিক্রি।
ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের একটি গবেষণাপত্র অনুসারে ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, রোগীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিক্রয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ইউএস ফার্মা কনসালটেন্সি ফার্ম আইকিউভিআইএ এর ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কেট ডেটার ওপর ভিত্তি করে ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আলসারের জন্য দায়ী। বিশেষ করে ভেজাল খাদ্য, অতিরিক্ত তেল ও মশলাযুক্ত খাবার খাওয়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। একই সঙ্গে যে কোনো বয়সেই পরিপাকতন্ত্রে আলসার হতে পারে। অ্যাসিডের আধিক্য, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এই রোগের মূল কারণ। লক্ষণ বুঝে, ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে আলসার থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মো. মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আলসার এবং মেটাবলিজম সংক্রান্ত ওষুধের চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, তেল এবং মশলার অত্যধিক ব্যবহার পাকস্থলীর ভেতরে আরো অ্যাসিড তৈরি করে। যখনই কেউ এ ধরনের সমস্যা অনুভব করে তখনই ওষুধ খেয়ে নেয়। এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়ায় সাধারণত মানুষ চিকিৎসকের কাছে যান না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এ কারণে তাদের প্রয়োজন হোক বা না হোক, কিংবা অন্য ওষুধের প্রয়োজন হলেও নিজেদের ইচ্ছে মতোই ওষুধ খেয়ে নেন।
প্রতি বছর গড়ে ৮ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার আলসারসহ অ্যালিমেন্টারি ট্র্যাক্ট এবং বিপাক সংক্রান্ত রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ বিক্রি হয়েছে। যা দেশে মোট বিক্রি হওয়া ওষুধের প্রায় ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ইসোমিপ্রাজল। আলসারের এই ওষুধ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার। যা বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া ২৩ হাজার কোটি টাকার ওষুধের প্রায় ৭ শতাংশ। থেরাপিউটিক ওষুধের বিক্রির বার্ষিক বৃদ্ধির হার সাড়ে ১২ শতাংশ।
২০১৫ সালে অ্যালিমেন্টারি ট্র্যাক্ট এবং মেটাবলিজমের সঙ্গে যুক্ত অসুস্থতা নিরাময়ে ওষুধের বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা এবং এটি মোট বিক্রির ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ৮ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার অ্যালিমেন্টারি ট্র্যাক্ট এবং মেটাবলিজম শ্রেণির ওষুধ বিক্রির মধ্যে আলসারের ওষুধ বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার। যা দেশের মোট বিক্রি হওয়া ওষুধের ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, মানুষের আয় যেমন বাড়ছে, ওষুধের ব্যবহারও বাড়ছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৫৯১ ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা ২০১৪-১৬ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
আবদুল মুক্তাদির বলেন, মানুষের আয় বাড়লে তারা ভালো খাবার খান এবং স্বাস্থ্যবিধি ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখেন। এতে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমে যায়।
ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের বিশ্লেষণ অনুসারে, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিক্রির বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা অন্য সব ধরনের ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে কম।
২০১৫ সালে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৯৯ কোটি টাকার, যা মোট বিক্রির ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে এই বিক্রি দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকায়, যা মোট বিক্রির ১৪ শতাংশ। আবদুল মুক্তাদির জানান, যখন মানুষের আয়ু বাড়ে, তখন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং আর্থ্রাইটিসের মতো অসংক্রামক রোগও বেড়ে যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট নথি অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড় আয়ু ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল ৫৯ বছর। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছরে।
এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালসের বিপণন ও বিক্রয়ের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামও একই কথাই বলেন। তিনি জানান, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম সম্পর্কিত ওষুধের বিক্রি বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অত্যধিক ব্যবহার করে, যা হতাশার কারণ হয়। এর ফলে মানুষের সক্রিয়তাও কমে যায়। এতে করে হার্টের সমস্যা এবং ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের বৃদ্ধি ঘটে। এটি এখন বিশ্বব্যাপী সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
কার্ডিওভাসকুলার রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত ওষুধের বিক্রি ২০১৫ সালে ছিল ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। যা সে বছরের মোট বিক্রির ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২০ সালে এর বিক্রি দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকায়। যা দেশের মোট বিক্রি হওয়া ওষুধের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির গতি ধীর হওয়া সম্পর্কে গতি সম্পর্কে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় সংক্রামক রোগ তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের দিকে নিয়ে যায় সে বিষয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছেন।
এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার এম মহিবুজ জামান জানান, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি বলেন, সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ও সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কর্মসূচি চালাচ্ছে। তাই এর বিক্রি খুব বেশি বাড়ছে না।
২০১৫ সালে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সম্পর্কিত ওষুধ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫১ কোটি টাকার। যা সেই বছর মোট বিক্রির ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সালে এই বিক্রি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকায়, যা বাজারের মোট বিক্রির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এম মহিবুজ জামান বলেন, ঋতু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ এবং মৌসুমি জ্বরের কারণে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা যায়।
উল্লেখ্য, আলসারের লক্ষণ বুকজ্বালা, পেটের উপরের দিকে যন্ত্রণা, খাওয়ার পরে পেট ফুলে থাকা বা পেট ফেঁপে থাকা, মুখ দিয়ে নুন জল ওঠা, গা বমি ইত্যাদি হলে বুঝতে হবে পেপটিক আলসার হতে পারে। এ ছাড়া একটি গ্যাস্ট্রিক আলসার হলে- খাওয়ার পরেই পেট জ্বালা করবে। এই সময়ে রোগী খেতে ভয় পাবেন, খাওয়ার প্রতি অনীহা তৈরি হবে। অন্যদিকে, ডিওডিনাম আলসার অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্তে আলসার হলে, পেট খালি থাকলে বা দীর্ঘক্ষণ না খেলে পেটে জ্বালা করবে। এগুলো খুব সাধারণ লক্ষণ। এর থেকে এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন