নদী ভরাট-দূষণে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
ভারতের পানি আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীর আজ মরণ দশা। এদেশের ভাটি অঞ্চল বা পানির এলাকা হিসাবে চিহ্নিত বৃহত্তর সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারাসহ ৫৩টি ছোট বড় নদী এখন মৃত্যুর মুখে। সুরমা কুশিয়ারার বুকে এক সময় জাহাজ চলতো। সে কথা এখন রূপকথার গল্পের মতো। সুরমা-কুশিয়ারার বুকে এখন নৌকা চলাও দায়। নদীর বুকে পানি নেই। শুকনো জীর্ণ-শীর্ণ মরা খালে পরিণত হয়েছে। এতে কমছে মাছ ও জলজ প্রাণী। বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র, কৃষি অর্থনীতি এবং জলবায়ুর ওপর।
ভারতের মণিপুর রাজ্যের মাও সাংসাং থেকে উৎপন্ন বরাক নদী হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা দুই শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। ভারত সেই বরাক নদীর টিপাই মুখে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে বাংলাদেশের সুরমা কুশিয়ারা এবং বৃহত্তর সিলেটে এদের শাখা প্রশাখা নদীগুলোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমানে শুকনো মৌসুমে বরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সুরমা নদী। সে জন্য সুরমা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সুরমা-কুশিয়ারা শুকিয়ে এর অববাহিকায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।
সিলেটের অধিকাংশ বড় নদীর উৎস উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়াহিল ও ত্রিপুরা রাজ্যে। মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতে অবাধ বৃক্ষ নিধন ও পাহাড়ে চলা অপরিকল্পিত কয়লা ও পাথর উত্তোলনের প্রভাবে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটিতে নদীর শুধু তলদেশ নয়, উৎসমুখ পর্যন্ত ভরাট হচ্ছে। এর ফলে ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃহত্তর সিলেটের খর¯্রােতা নদী সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, লোভা পিয়াইন, বৌলাই, রক্তি, যাদুকাটা, মনু, খোয়াই, সুতাংসহ ৫৩টি নদী এখন প্রায় মৃত। সব নদীউ প্রবাহহীন মরাখালে পরিণত হয়েছে। ভারতের পাহাড়ি ঢলে পানির বদলে পলি-বালিতে ভরাট হয়েছে নদীগুলো। নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও নদী পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। প্রতি বছরই বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় সিলেট বিভাগের নিম্নাঞ্চল। দখলে-দূষণে-ভরাটে নদীর পানি সহজাতভাবে নামতে পারছে না। এতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। এছাড়া ভাঙনের কবলে বদলে গেছে সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলের মানচিত্র।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সুরমা ও কুশিয়ারাসহ ৩০টি ছোট-বড় নদী এবং মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই এবং হবিগঞ্জের খোয়াইসহ বিপন্ন হয়ে পড়েছে ২৩টি নদ-নদীই। এমতাবস্থায় এ অঞ্চলের নদ-নদী-খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে কানাইঘাট উপজেলার নকলা ও জৈনকা খাল খনন করা হয়। তবে এ প্রকল্প বাস্তয়নের ধীর গতিতে এলাকাবাসী হতাশ। অপরদিকে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, সুরমা কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদীর ১০ হাজার কিলোমিটার খননে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ)। বর্তমানে বড় বাজেটের এ প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
নদী সুরক্ষার আন্তর্জাতিক অ্যালায়েন্সের সদস্য সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বেহাল সুরমার বিষয়ে বলেন, সিলেটের অধিকাংশ বড় নদীর উৎস উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়াহিল ও ত্রিপুরা রাজ্যে। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার এবং পাহাড়ে অপরিকল্পিত কয়লা ও পাথর উত্তোলনের ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটিতে নদীর শুধু তলদেশ নয়, উৎসমুখ পর্যন্ত ভরাট হচ্ছে। ইতোমধ্যে বরাক নদীর উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে সুরমা নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে সুরমা এবং এর শাখা নদীগুলো শুকিয়ে যায়।
এক সময় বরাক হয়ে আসা পানির ৬০ শতাংশ কুশিয়ারায় এবং বাকি ৪০ শতাংশ সুরমা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু উৎসস্থল অমলসিদ থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার পর্যন্ত সুরমার যাত্রাপথে স্থানে স্থানে চর জেগে উঠায় এখন ৮০ শতাংশ পানিই যাচ্ছে কুশিয়ারায়। অন্যদিকে ২০ শতাংশ পানি নিয়ে সুরমা ক্রমেই রূপ নিচ্ছে মরা নদীতে। সুরমা নদীর সিলেট অংশের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০টি স্থানে চর জেগেছে। দীর্ঘদিন থেকে নদী খনন না হওয়ায় ধীরে ধীরে ¯্রােতস্বীনি সুরমা মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র আরও জানায়, বর্ষা মৌসুমে সুরমা নদীর ওয়াটার লেভেল থাকে ১১-১২ মিটার। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে মৌসুমে এই লেভেল ১ মিটারের নিচেও নেমে আসে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভারনমেন্টাল বিভাগের প্রফেসর ড. জহির বিন আলম সুরমা নদীর ওপর এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করেন-সুরমা ভরাট হয়ে গভীরতা হ্রাস পেয়েছে। সুরমাকে বাঁচাতে ড্রেজিং জরুরি। শুধু সুরমা নয় কুশিয়ারাসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য নদীও খনন করা জরুরি। সিলেট বিভাগের ৫৩টি নদীর পানিপ্রবাহ নির্ভর করে সুরমা-কুশিয়ারার বেঁচে থাকার ওপর। এ ছাড়া এ অঞ্চলের অনেক হাওর বিল এগুলোর জীবনও সুরমা কুশিয়ারার উপর নির্ভরশীল। তাই সিলেট বিভাগের নদীগুলো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন