বর্তমান শুষ্ক মওসুমই দেশে নির্মাণকাজ, উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তাছাড়া দেশে ও বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আর, এ সময়েই দেশে হু হু করে বাড়ছে সবধরনের নির্মাণ সামগ্রীর দাম। বিশেষ করে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে রড। সেই সাথে লোহাজাত সব সামগ্রী এবং সিমেন্টের মূল্য এখন আকাশছোঁয়া। প্রতিদিনই হরেক ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর বাড়ছে দাম। এর ফলে সারাদেশে স্থবির হয়ে পড়েছে উন্নয়ন কার্যক্রম। কখনও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত, কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাত, কখনওবা দেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান অজুহাতে বাড়ছে সবধরনের নির্মাণ সামগ্রীর দাম। আমদানি নির্ভর কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত সামগ্রীর পাশাপাশি ইট-বালি-কংকর (খোয়া), কাঠ-বাঁশ থেকে শুরু করে দেশীয় নির্মাণ সামগ্রীর দামও ঊর্ধ্বমুখী। তাছাড়া মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অনেকক্ষেত্রে অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিকেও দায়ী করছেন ক্রেতারা।
নির্মাণ সামগ্রীর লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে থমকে গেছে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজের গতি। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক মেগাপ্রকল্পের পাশাপাশি বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছোটবড় মাঝারি বিভিন্ন আকারের প্রায় দুই হাজার উন্নয়ন প্রকল্প কাজে গতি কমেছে। অনেকগুলো থেমে গেছে। আবাসন ব্যবসাও হঠাৎ হোঁচট খেয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মাণাধীন ভবনের কাজও গেছে থমকে। সারাদেশে নগর থেকে গ্রাম পর্যায়ে সড়ক উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। নির্মাণ সামগ্রীর আকাশছোঁয়া দামে কাজ না করতে বেঁকে বসেছেন ঠিকাদার ও তাদের নিয়োজিত শ্রমিকেরা। চট্টগ্রামে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও করেছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে প্রায় দুই বছরের মত উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণখাতে স্থবিরতা বিরাজ করে আসছিল। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে ব্যাপকহারে কাজ শুরু হয়েছে। তাতে বেড়ে গেছে নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারের অস্থিরতাসহ নানা কারণে এবং অজুহাতে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়ন খাত এখন নতুন করে সঙ্কটের মুখে পড়েছে। তাতে দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দেশে উন্নয়ন ও নির্মাণ খাতে এমন অচলদশায় এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থানসহ সব খাত, উপখাতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। লাখ লাখ শ্রমিকের আয়-রোজগারে টান পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত স্বল্প আয়ের মানুষেরা এখন দিশেহারা। কবে নাগাদ নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য স্থিতিশীল হবে তা বলতে পারছেন না কেউই। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল না হলে দেশে নির্মাণ সামগ্রীর দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এসব খাতের সংশ্লিষ্টরা। রডের দাম টনপ্রতি লাখ টাকা ছুঁতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, নির্মাণ খাতের প্রধান উপকরণ এম এস রডের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রায় সব ধরনের রডের দাম টনপ্রতি ১৪ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। গতকাল নগরীর ষোলশহর ২নং গেইট এলাকার আল চিশতি ট্রেডিংয়ে গিয়ে দেখা যায়, সবচেয়ে ভালোমানের ৭৫ গ্রেডের এমএস রড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকা। কয়েক মাস আগেও এর দাম ছিল ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা। ৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার টাকা। কয়েক মাস আগে দাম ছিল ৫৫ থেকে ৫৬ হাজার টাকা। অটোগ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৮৪ হাজার টাকা। যা আগে ছিল ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা।
প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মোরশেদুল আলম বলেন, রডের পাশাপাশি সিমেন্টের দামও বস্তাপ্রতি ৯০ থেকে ১০৫ টাকা বেড়েছে। এখন প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৪৮০ থেকে ৪৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অগ্রিম টাকা দিয়েও রি-রোলিং মিল থেকে রড পাওয়া যাচ্ছে না। সিমেন্টের সরবরাহও কমে গেছে। মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রেখেছেন। এর ফলে ব্যবসাও স্থবির হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানান, প্রতি হাজার ইট ১০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১১-১২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বালু এবং কংকরের দাম প্রতি বর্গফুটে চার থেকে পাঁচ টাকা হারে বেড়েছে। বেড়েছে পাথরের দামও। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এসব নির্মাণ সামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়। রড, সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় আরেক দফায় এসব দেশীয় সামগ্রীর দাম বেড়েছে। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে সব ধরনের রং, টাইলস এবং বিটুমিনের দামও বেড়েছে। ইটভাটা মালিক সমিতির নেতারা জানান, প্রশাসনের অভিযানে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইটের সরবরাহ কমে গেছে। আর তাতে বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া কয়লা এবং গ্যাস দিয়ে ইট পোড়াতে গিয়ে ইট উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০০টি লোহা ও ইস্পাত কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ টন। আর অভ্যন্তরীণ ইস্পাত ব্যবহারের পরিমাণ ৭৫ লাখ টন। সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা ৩৮টি হলেও উৎপাদনে আছে ৩৪টি। এসব কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার কোটি টন। এসব খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রড-অ্যাঙ্গেলসহ নির্মাণখাতে ব্যবহৃত লোহাজাত সামগ্রীর সরবরাহ আসে রি-রোলিং মিল থেকে। এর প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে স্ক্র্যাপ জাহাজ। দেশে উৎপাদিত এমএস রডসহ লোহাজাত ও ইস্পাত সামগ্রীর ৭০ শতাংশই জোগান আসে চট্টগ্রামের কারখানাগুলো থেকে।
শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী স্ক্র্যাপ জাহাজের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে দামও বেড়েছে। জাহাজ ভাড়া রেকর্ড অতিক্রম করেছে। দেশেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। আর এ কারণে রডসহ লোহাজাত সামগ্রীর দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান এবং বিশ্ববাজারে দাম না কমা পর্যন্ত নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক মো. হাকিম আলী বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বিশ্বব্যাপী নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে বিশ্ববাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের দামও বেড়ে গেছে। আগে থেকেই বাড়ানো হয়েছে জাহাজ ভাড়া। এর প্রভাবে সিমেন্টের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। বাজারে দামও এখন বাড়তি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন