বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সড়ক যেন টার্মিনাল

চট্টগ্রামে জনদুর্ভোগ : ব্যাহত আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন মিলছে না উন্নয়নের সুফল

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

সড়কের দুইপাশে সারি সারি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরি। আছে বাস, টেম্পোসহ হরেক যানবাহন। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই এটি সড়ক না কোন টার্মিনাল। চট্টগ্রামের লাইফলাইনখ্যাত পোর্ট কানেকটিং রোডের চিত্র এটি। বন্দর-নিমতলা থেকে বড়পোল পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়ক দখল করে রাখা হয়েছে ভারী যানবাহন। তাতে সংকুচিত হয়ে পড়েছে মূল সড়ক। এতে সড়কে যানজট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে।

দীর্ঘ অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে সংস্কারের অভাবে এ সড়কটির বেহাল অবস্থা ছিল। তাতে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী যানবাহনের তীব্র জট স্থায়ী রূপ নেয় সড়কটিতে। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ সৃষ্টিকারী এ সড়কের বেহাল অবস্থায় বিঘ্নিত হয় আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন। আশপাশের লাখো মানুষকে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। ১৭০ কোটি টাকায় পাঁচ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার সড়কটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজ এখন প্রায় শেষদিকে।

তবে কাজ শেষ না হতেই সড়কটি বেদখল হয়ে যাওয়ায় উন্নয়নের সুফল মিলছে না। আগের মতই তীব্র যানজটে অচল হয়ে পড়ছে পুরো এলাকা। এর প্রভাবে বন্দর, পাহাড়তলী, আগ্রাবাদ, হালিশহরসহ নগরীর বিরাট অংশে স্বাভাবিক যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। পোর্ট কানেকটিং রোডের মত নগরীর সিটি আউটার রিং রোড, বন্দর-পতেঙ্গা, সদরঘাট, মাঝিরঘাট এলাকাসহ বেশিরভাগ সড়কই এখন অঘোষিত টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দর এবং দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জের কারণে নগরীতে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরিসহ ভারী যানবাহন চলাচল করছে। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত ট্রাক টার্মিনাল। সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহি যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। তাতে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর।

নগরীতে ছোট দুটি বাস টার্মিনাল রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। ফলে নগরীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে বাস ও ট্রাক টার্মিনাল। সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরীতে অন্তত আটটি বাস ও ১৪টি অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড রয়েছে। রাস্তা দখল করে এসব টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড গড়ে ওঠায় পুরো নগরীতেই চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। কোন একটি সড়কের সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন কাজ শেষ হতেই তা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শত শত কোটি টাকার উন্নয়নের সুফল মিলছে না। নগরীতে স্থায়ী ট্রাক এবং বাস টার্মিনাল নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। সিটি কর্পোরেশন এবং সিডিএ চারটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। তবে একটিও বাস্তবায়ন হয়নি এখনো।

পোর্ট কানেকটিং রোডে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। যার ৯০ ভাগই আমদানি-রফতানি পণ্য ও কন্টেইনারবাহি ভারী যানবাহন। কিন্তু সড়কের অর্ধেক অংশে অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে যানবাহন চলাচল মারাত্মক বিঘ্নিত হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, বন্দর-নিমতলা পয়েন্ট থেকে শুরু করে বড়পোল পর্যন্ত এলাকায় সড়কের দু’পাশ দখল করে সারি সারি ভারী যানবাহন রাখা হয়েছে। সরু অংশে চলছে ভারী যানবাহন ও গণপরিবহন। এর ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সড়কটিতে যানজট স্থায়ী হচ্ছে।

পরিবহন চালকেরা জানান, চার লেনের এ সড়কে দুই লেন বেদখল হয়ে গেছে। এর ফলে পাঁচ কিলোমিটার সড়কটি পার হতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। এর প্রভাবে নগরীর আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পাহাড়তলী ডি টি রোড, সাগরিকা হয়ে এ কে খান গেইট পর্যন্ত তীব্র যানজট হচ্ছে। এ সড়কে চলাচলকারী বাস, মিনিবাসসহ গণপরিবহনের যাত্রীদের নিত্যদুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিটি আউটার রিং রোডেও রয়েছে অবৈধ পার্কিং। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে জেলেপাড়া অংশে শত শত ভারী যানবাহন পার্কিং করে রাখা হচ্ছে। এ কারণে ওই সড়কেও তীব্র যানজট হচ্ছে।

পতেঙ্গা এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো। ডিপোগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি পণ্যবাহি পরিবহন আসছে। এর ফলে প্রতিটি ডিপোর সামনের সড়ক দখল করে রাখা হচ্ছে এসব ভারী যানবাহন। পতেঙ্গা সৈকত থেকে কাটগড় হয়ে স্টিল মিল পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে রাখা হচ্ছে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, লরি, কন্টেইনার মোভারসহ ভারী যানবাহন। কাটগড় থেকে স্টিল মিল পর্যন্ত অংশে সিটি সার্ভিসের অসংখ্য বাস রাখা হয় রাস্তার দু’পাশে। বিমানবন্দর সড়কের বিজয়নগর থেকে শুরু করে ১২ নং ঘাট পর্যন্ত সড়কেও রাখা হচ্ছে ভারী যানবাহন। বন্দরে প্রবেশের জন্য নগরীর প্রধান সড়কের সল্টগোলা ক্রসিং থেকে মাইলের মাথা পর্যন্ত সড়কের একপাশ দখল করে শত শত ভারী যানবাহন রাখা হচ্ছে।

একই অবস্থা বন্দর ফ্লাইওভারেও। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারের দু’পাশে সারি সারি ভারী যানবাহন। এর ফলে রাতে-দিনে ২৪ ঘণ্টা ফ্লাইওভারের ওপরে যানজট লেগে আছে। বন্দর এলাকায় যানজট কমাতে নির্মাণ করা হয় বন্দর থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত টোল রোড। ওই টোল রোডের অর্ধেক এখন অবৈধ ট্রাক টার্মিনাল। হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান রাখা হয় এ সড়কে। ট্রাক মালিক সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, নগরীতে যত সংখ্যক ভারী যানবাহন আছে তার তুলনায় পর্যাপ্ত টার্মিনাল নেই। বন্দর এলাকায় একটি টার্মিনাল থাকলেও সেখানে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এর ফলে বাধ্য হয়ে এসব ভারী যানবাহন রাস্তায় রাখা হচ্ছে।

ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, পোর্ট কানেকটিং রোড, আউটার রিং রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবৈধ পার্কিং বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে টার্মিনাল না থাকায় এক সড়ক থেকে তুলে দেয়ার পর অন্য সড়কে গিয়ে এসব গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে। সড়ক দখল করে গাড়ি রাখায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশকে। নগরীর নিমতলায় একটি স্থায়ী ট্রাক টার্মিনাল রয়েছে। এর বাইরে অবৈধভাবে পোর্ট কানেকটিং রোড, ডি টি রোড চাল বাজার সংলগ্ন সড়ক, বারো কোয়ার্টার, মনসুরাবাদ, কাঁচা রাস্তা, বড়পোল, মাদারবাড়ি, সদরঘাট, মাঝিরঘাট, বাংলা বাজার ও অক্সিজেন মোড়ে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড গড়ে ওঠেছে।

মহানগরীতে নেই পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল। সিডিএর উদ্যোগে বহদ্দারহাটে একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হলেও সেটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নগরীর কদমতলীতে রয়েছে আরও একটি বাস টার্মিনাল। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের বাস ছেড়ে যায়। আর কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়ে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার যাত্রীবাহী বাস। এ দুটি টার্মিনালের বাইরে গরীবুল্লাহ মাজার সংলগ্ন মোড়, অক্সিজেন মোড়, চান্দগাঁও, কর্ণফুলী সেতু সংলগ্ন মোড়, মাদারবাড়ি, অলংকার মোড় এবং এ কে খান গেইটে গড়ে ওঠেছে অঘোষিত বাস স্ট্যান্ড। এর পাশাপাশি নগরীর স্টেশন রোড, বায়েজিদ সড়ক, ইপিজেড, বন্দরটিলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস কাউন্টারগুলো থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। ফলে এসব সড়কে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন