শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

রোজাদাররা যানজটে নাকাল

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বাড়তি উদ্যোগ চোখে পড়েনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস খোলা স্থবির রাজধানী ঢাকা

একলাছ হক : | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

ভোগান্তি যেন পিছু ছাড়ছে না রাজধানীবাসীর। রমজানের প্রথম দিনেই পড়তে হয়েছে যানজটের কবলে। গতকাল সকালের দিকে রাজধানীতে যানজট কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে যানজট। সারাদিনের তীব্র গরম ও রাস্তার যানজটের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে নগরবাসীকে। বিশেষ করে এবছর রমজান মাসেও অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকার কারণে অনেক সড়কেই যানবাহনের জটলা দেখা গেছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এমন এলাকায় সকাল থেকেই যানজটের পরিস্থিতি ছিলো ভয়াবহ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ ও অফিসগামী যাত্রীরা।
রমজানের প্রথম দিনে ইফতারির আগে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে অফিস টাইম শেষ হওয়ার পর থেকে সড়কে যানবাহনসহ মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ফলে রমজানের প্রথম ইফতারির আগে রাজধানী জুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস, এরমধ্যে রমজানের প্রথম দিন, যে কারণে ইফতারির ঠিক আগ মুহূর্তে সড়কে বেড়েছে মানুষ এবং যানবাহনের উপস্থিতি।
গতকাল রোববার রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, প্রেসক্লাব, ফার্মগেট, শাহবাগ, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, সাইন্সল্যাব এলিফ্যান্ট রোড, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, লিংরোড, কুড়িল বিশ্বরোড, উত্তরা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ পুরো নগরীতেই যানচলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। স্বল্প দুরত্বের পথ অতিক্রম করতে দীর্ঘসময় সিগন্যালে আটকে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পথচারীরা।
জানা যায়, গত দুই বছরে করোনার কারণে অফিস-আদালত সীমিত ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। রোজা শুরুর আগ থেকেই যানজট তীব্র। এবার অফিস সাড়ে তিনটা পর্যন্ত খোলা। এক শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকাল সাড়ে ৯টা কিংবা ৮টায় শুরু হয়ে দুপুর ১টায় ছুটি হবে। স্কুলভেদে দুই শিফটের স্কুলের প্রভাতী শাখা সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হয়ে দুই ধাপে বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত চলবে। ইফতারের চিন্তায় প্রায় কাছাকাছি সময়ে মানুষ বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। এমন অবস্থায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করে।
এবার রোজার আগে থেকেই যানজট অসহনীয় হয়ে পড়েছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে যানজট বেড়ে গেছে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেলের স্টেশনের কাজ করছে বিভিন্ন এলাকায়। স্টেশনের কাজের কারণে বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, প্রেসক্লাব এলাকায় সড়কে রাস্তা সরু হয়েছে। নগরজুড়ে সড়কে চলছে উন্নয়ন কাজ। সিটি করপোরেশন রাজধানীর ভিন্ন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করছে। উন্নয়ন কাজের কারণে রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে গাড়ির দীর্ঘ সারি পড়েছে।
অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে জরিমানা, যেখানে-সেখানে ইউটার্ন বন্ধ করা, ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে গণপরিবহনকে মানুষের জন্য আরও সহজ-সুলভ করা, ঢাকা বাইপাসগুলোকে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে দ্রুত বাস্তবায়ন করার পরামর্শ গণপরিবহনের যাত্রীদের। স্টপেজ ছাড়া সড়ক থেকে কোনো যাত্রী তোলা ও নামাতে গণপরিবহনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। রাস্তায় চলাচলের প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ পাওয়া গেলে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন ট্রাফিক সার্জেন্টরা। পবিত্র রমজানের প্রথম কয়েক দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে জনবল ঢেলে সাজানো হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ঢাকার সড়কে এক লাখ ১৮ হাজার এবং ২০২১ সালে এক লাখ ৫০ হাজার নতুন যানবাহন নেমেছে। চলতি বছরে প্রথম দুই মাসে নেমেছে ২৯ হাজার ৬৭৮টি যানবাহন। গত দুই বছরে তিন লাখ গাড়ি বেড়েছে। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি। ফলে রমজানের শুরুতে যানজট ও ভোগান্তির শঙ্কা রয়েছে। সরকারের পরিবহন পরিকল্পনা হিসাব করলে দেখা যাবে, ১৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পাঁচটি এমআরটি চালু করা হবে। অথচ সেগুলো পুরো পরিবহনের মাত্র ১৭ শতাংশের চাপ নিতে পারবে। তখনো ৪০ শতাংশ চাপ নেবে গণপরিবহন।
বুয়েটের হিসাব মতে, যানজটে ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এক দশক আগে ঢাকার যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, সেখান থেকে নামতে নামতে সেটি এখন ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার, প্রায় হাঁটার গতির সমান। অনেকে করোনায় স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার কারণে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনেছেন। অনেকে কাজ হারিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য রিকশা, ভ্যান ও রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এতে করে ঢাকা শহরে আগের তুলনায় চাপ বেড়েছে। সেই তুলনায় বাড়েনি রাস্তা। বরং ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে ঢাকার রাস্তা। রাস্তার ধারণক্ষমতা না থাকলেও চাপ নিতে হচ্ছে এ দেশের যানবাহনকে। যেখানে-সেখানে পার্কিং, অযান্ত্রিক বাহনের আধিক্য যানজটকে তীব্র করে দেয়। চলমান উন্নয়ন কাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় এবারের রমজানে সড়ককে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখাকে বড় চ্যালেঞ্জ বলছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা। ডিএমপির এক বৈঠকে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, যেখানে- সেখানে যাত্রী না ওঠানো-নামানো বন্ধে আলোচনা হয়।
এদিকে, রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মার্কেটে ক্রেতাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মার্কেটের নিরাপত্তা এমনকি যানজট নিরসন করে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সহায়তা চাওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ছিনতাইকারী, টানা পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি সম্পর্কে সজাগ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানানো হয়েছে। গত ২৯ মার্চ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা যানজট নিয়ন্ত্রণ, ক্রেতাদের নির্বিঘ্নে চলাচল, চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের কার্যকরী ভূমিকা, রাতের বেলায় মার্কেটকেন্দ্রিক নিরাপত্তা, শপিং শেষ করে ক্রেতারা যেন ছিনতাই কিংবা অজ্ঞান পার্টির সম্মুখীন না হয় সে ব্যাপারে পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়।
সম্প্রতি অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম ঈদ ও রমজানকে কেন্দ্র করে জনগণের চলাচল নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশকেও ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি, মলম পাটির তৎপরতা ঠেকাতে এসব চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতারের নির্দেশনাও দেন। এছাড়াও থানা পুলিশকে টহল বাড়ানো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাস যাত্রী সাবিরুল বলেন, রমজানের প্রথম দিন সকালে যানবাহনের চাপ কম থাকলেও দুপুরের দিকে আস্তে আস্তে গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। বিকেলের দিকে এমন পরিস্থিতি হয় যেন বাড়িতে ফিরতে কত সময় লাগবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। আর রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের মধ্যে সবাই তারাতারি বাড়িতে ফেরার প্রবণতা দেখা যায়। একসাথে সবাই অফিস থেকে বের হয়েছে তাই যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে।
আরেক যাত্রী তারেক বলেন, বাসের চালক ও হেলপাররা রমজানের প্রথম দিনেও রাস্তা থেকে যাত্রী উঠা নামা করার কারণে অনেক স্থানে বাসের জটলা সৃষ্টি করছেন। এতে করে রোজা রেখে গরমের মধ্যে খুবই কষ্ট করতে হয়েছে। তীব্র কষ্ট হলেও তারা যাত্রীদের কোন কথাই শুনছে না। এ কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় আরও বেশি লাগছে।
ফুলবাড়িয়া এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট হাবিবুর রহমান বলেন, প্রথম রমজানের কারণে সকালের দিকে গাড়ির চাপ কম থাকলেও বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ির চাপ ছিলো বেশি। রাতের বেলায় এই এলাকায় দোকানগুলোর মাল পরিবহনের গাড়ির কারণে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। বড় বড় ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থেকে মাল উঠানামা করানোর কারণে ভোর পর্যন্ত এই এলাকা থাকে যানবাহনের চাপ আর এই সমস্যা গিয়ে দিনের বেলা চলাচলকারী পরিবহনের যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ায়।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, যানজট নিরসনে সরকার, পুলিশ ও পরিবহন মালিক সংশ্লিষ্টদের আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। রোজার মাসে সবাই চাইবে প্রায় একই সময়ে বাড়ি ফিরতে। যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি তৎপর হতে হবে। রাস্তার মোড়গুলোতে গাড়ি যেন আটকা না পড়ে সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মোড়গুলোতে পুলিশকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। রোজার সময় ফুটপাথগুলো পরিস্কার রাখতে হবে। ফুটপাথের বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। ফুটপাথ থেকে দোকান সরাতে হবে। তানা হলে রাস্তাগুলোতে চলাচল স্বাভাবিক হবে না। শুধু অভিযান সর্বস্ব হলে চলবে না। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে চালু আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কর্মক্ষেত্রও সচল। এ রকম অবস্থায় মানুষের যাতায়াতের পথটি মসৃণ করতে হবে। তাই এনফার্সমেন্টের ওপর জোর দিতে হবে। গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যাপারে খুব সজাগ থাকা দরকার। রোজা ও অতিরিক্ত গরমের সময় হয়তো পুলিশের পক্ষে ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই ঈদের সময় যেভাবে অন্য বাহিনী মাঠে কাজ করে তেমনভাবে রোজার সময়ও কাজ করা দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন