‘সিলেকশন অব কনট্রাক্টর ফর প্রোভাইডিং সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস টু টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড’ শীর্ষক দরপত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের কাজ দেয়ার প্রক্রিয়াতেই ‘পাহাড় সমান’ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে ফেনীতে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা মামলাসহ সরকারবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত ১২টি মামলার আসামির প্রতিষ্ঠানকে টেলিটকের কাজ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। কাজটি পেয়েছে আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেড। মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের প্রভাব খাটিয়ে দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে কাজ দেয়ার অভিযোগ করেছে যমুনা স্টার সেফ গার্ড লিমিটেড ও স্কলাস্টিকা সিকিউরিটিস কোম্পানি। দুই প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তবে অভিযোগ তদন্ত চলাকালেই আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ করার অনুমোদন দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এদিকে নানা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে তদন্ত কমিটির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠান দুটির অভিযোগ অনুযায়ী, টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাহাব উদ্দিন টাকার বিনিময়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সিপিটিইউ স্ট্যান্ডার্ড ডকুমেন্ট পাশ কাটিয়ে ওই কোম্পানির অভিজ্ঞতার আলোকে দরপত্রে মানদন্ড নির্ধারণ করায় অনেক কোম্পানি প্রতিযোগিতায় অংশই নিতে পারেনি। এ ছাড়া দরপত্রের মূল শর্তের জিসিসি, ২০ (ক) মতে, কলকারখানা অধিদফতরের হালনাগাদ ঠিকাদারি লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হলেও আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডের তা ছিল না। তবুও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে দুইবার দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং মূল্যায়ন কমিটি পরিবর্তন করা হয়। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু তালেব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে ফেনীতে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা মামলাসহ সরকারবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত ১২টি মামলার আসামি বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিষ্ঠান দুটির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে মাস পার হলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। এদিকে তদন্ত চলাকালেই আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্তের অগ্রগতি জানতে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্মসচিব (টেলিকম) খোন্দকার মো. আবদুল হাইয়ের মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনকল ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটির অপর সদস্য টেলিযোগাযোগ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমি বাইরের সদস্য। আমাকে এখনো ডাকা হয়নি।
জানা গেছে, টেলিটক গত বছরের ২৩ জুন ‘সিলেকশন অব কনট্রাক্টর ফর প্রোভাইডিং সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস টু টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি দরপত্র আহ্বান করে। সেই আহ্বানে আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেড, কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড, সিকিউরিটাস সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসেস লিমিটেড অংশ নেয়। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, একমাত্র কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিস ছাড়া বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল না। অথচ, শর্তানুযায়ী দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারি সংস্থার কলকারখানা অধিদফতর থেকে হালনাগাদ লাইসেন্স থাকতে হবে।
অনিয়মের অভিযোগ চলাকালীন সময়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে টেলিটকের প্রকিউরমেন্ট বিভাগের ডিজিএম শরীফুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, যে কোনো বড় কাজ অনুমোদনের জন্য বোর্ডে যায়। বোর্ডের চেয়ারম্যান সচিব সাহেব। বোর্ডের সিদ্ধান্ত আমরা বাস্তবায়ন করি। তদন্ত কমিটির কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসন বিভাগে যোগাযোগ করবে।
এ ব্যাপারে টেলিটকের অ্যাডমিন বিভাগের ডিজিএম ও মূল্যায়ন কমিটি সদস্য সচিব কামরুজ্জামান বলেন, মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করেছে। সেই কমিটি এখনো আসেনি। তারা আসলে দেখবে সব ঠিক আছে কি না। তিনি আরো জানান, দরপত্রে অনিয়মের যে অভিযোগ, তার কোনো প্রমাণ নেই। দরপত্র দাখিলের সময় কোনো কোম্পানি লাইসেন্স নবায়নের কপি দিতে পারেনি। তবে নবায়নের আবেদন কপি জমা দিয়েছে।
এদিকে কোনো প্রতিষ্ঠান নবায়নের আবেদন করেই নবায়ণকৃত ভাবার সুযোগ আছে কি না- এ ব্যাপারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের কাছে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, কেবল নবায়নের আবেদন করলেই নবায়ন হয়েছে এটা ভাবার সুযোগ নেই। নবায়নকৃত লাইসেন্সের কপি হাতে পাওয়ার পরই লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে মর্মে গণ্য হবে।
এদিকে অনিয়মকে জায়েজ করতে ও টাকার ভাগাভাগি নিয়ে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি টিম একাধিক বার বৈঠকও করেছেন তারা। সেই বৈঠকে একটি অডিও রেকর্ড এসেছে ইনকিলাবের হাতে।
সেই রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনিয়মের কারণে গঠিত তদন্ত কমিটি যেন কোনোভাবেই টেলিটকে আসতে না পারে তার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তাদের চুক্তির বিষয়টি অনেকে জেনে গেছে বলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঝামেলায় আছেন বলেও শোনা যায়। টাকা দিয়ে সিপিটিইউ-সহ বিভিন্ন জায়গা ম্যানেজ করা ও ভালো আইনজীবী রাখার বিষয়ে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। আইনজীবি হিসেবে এমন দুইজনের নাম উল্লেখ করা হয় যে যিনি ও তার মেয়ে দুইজনই ব্যারিস্টার। এমনকি আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতাকে দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীকে ফোন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। তারা বলেন, ভাইকে দিয়ে ফোন দেয়াতে পারলে মন্ত্রী সাহেব বিষয়টি ভাল ভাবে দেখবেন। এ ব্যাপারে জানতে ওয়েবসাইটে দেওয়া টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাব উদ্দিনের টেলিটক নম্বরে ফোন দিলে নম্বরটি আর ব্যবহার হচ্ছে না বলে অপারেটর থেকে জানানো হয়। পরে তার দফতরের টেলিফোনে কল করলে কেউ রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য যে, টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাবুদ্দিন খালেদা জিয়ার সময় ০৬/০৪/২০০৪ইং তারিখ থেকে ২৪/০৯/২০০৬ইং তারিখ পর্যন্ত শেরে বাংলা নগর এক্সচেঞ্জের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয় ও রেড এক্সচেঞ্জের ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন