উপকূলবাসীর চরম দুর্যোগ ও বিভীষিকার দিন
নাছিম উল আলম : দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকাসহ দক্ষিণের ১৩টি জেলার প্রায় দেড় কোটি মানুষের কাছে বিভীষিকার ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ। ১৯৭০ সালে এই রাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’ ১০ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত নিয়ে উপকূলের বৃহত্তর বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলের ১০টি জেলায় প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আড়াই শ’ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়েছিল। বিভীষিকাময় হেরিকেনের তা-বে সে রাতে উপকূলের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। সে বিভীষিকা এখনো দক্ষিণ জনপদের মানুষকে তাড়া করে। পটুয়াখালী ও ভোলার অনেক পরিবার শিশুদের ‘হেরিকেন আইতেছে’ বলে এখনো ভয় দেখায়।
’৭০-এর ১২নভেম্বরের কালো রাতে উপকূলের বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ছাড়াও চট্টগ্রামের কিছু অংশে আছড়ে পড়েছিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সারা বিশ্বে স্মরণকালে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে ’৭০-এর ১২নভেম্বর রাতের ঘূর্ণিঝড় হেরিকেনের তা-বে। সে রাতে নির্মম প্রকৃতি বাংলাদেশের উপকূলভাগের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিলেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হিসেবে দুই লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়েছিল। নিখোঁজের সংখ্যাও ছিল আরো প্রায় আড়াই লাখ। যাদের বেশির ভাগেরই আর কোনো খোঁজ মেলেনি পরবর্তীকালে। লক্ষাধীক মানুষ জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে সেদিন সাগরে ভেসে গিয়েছিল। যারা চীরদিনের মতো চলে গিয়েছিল না ফেরার দেশে। এমনকি সে রাতে ভয়াল হেরিকেনের তা-বের শিকার নিকটজনের লাশও খুঁজে পায়নি হাজার হাজার পরিবার। পরিপূর্ণ ধংসস্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল দেশের পুরো উপকূলীয় জনপদ।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানসহ গোটা পাকিস্তানের সর্বাধীক অনুন্নত এ উপকূলীয় এলাকা প্রকৃতির রুদ্ররোষে আরো একবার সব হারানোর পরে অবশিষ্ট ছিল শুধু সাগরের গর্জন এবং মানুষ আর গবাদীপশুর শব মিছিল। আর বিভৎস ধংসস্তূপ থেকে ভেসে আসছিল স্বজন হারানোদের কান্নার রোল। প্রাণীর মরদেহের পচাগলা গন্ধে পুরো এলাকার জনস্বাস্থ্যও চরম বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। পানি, খাবার আর বসনের অভাবে উপকূলের বেশির ভাগ এলাকাতেই ঝড় পরবর্তীকালে চরম মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল।
’৭০-এর সে বিভীষিকা আজো উপকূলের বয়োজ্যেষ্ঠসহ সব বয়সী মানুষ দুঃসহ জাতনা নিয়েই স্মরণ করছেন। হেরিকেনের তা-বে গোটা উপকূলের শত শত মাইল জুড়ে শুধু বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, গাছপালা আর লাশের মিছিল ধংসস্তূপের সাক্ষর রেখে গেছে। হাজার হাজার গবাদীপশুর মৃতদেহ ,আর তার পচা গলা দুর্গন্ধে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে জীবনকে অনেকটাই দুর্বিসহই মনে হচ্ছিল। তারপরও প্রকৃতির ওই রুদ্ররোষ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই টিকে আছে আজো উপকূলের জনপদে। তবে ’৭০-এর সেই স্মৃতি বেঁচে থাকা সবাইকে আজো তাড়া করছে। সে স্মৃতিকে স্মরণ করে আজো ভোলাসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় নানা কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়েছে। স্বজন হারারা নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন