শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইনে আছে বাস্তবে নেই

প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গোলটেবিলে গণমাধ্যমের বিশিষ্টজনেরা
স্টাফ রিপোর্টার : বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আইনগতভাবে মুক্ত গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম। কখনো রাজনৈতিকভাবে, কখনো ব্যবসায়িক, আবার কখনো ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার অজুহাতে গণমাধ্যমের স্বাধীন মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা জগতের বিশিষ্টজনেরা। যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ভারত, নেপাল, ভুটান, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, সেøাভাকিয়াসহ বিশ্বের নয়টি দেশ থেকে আসা এসব বিশিষ্টজনেরা মনে করেন সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন মিডিয়ার ক্রমবিকাশে সাংবাদিকতার ধারা পাল্টে গেছে। এ দুটি মাধ্যম অনেকটা মতামতধর্মী। সেই ধারাটিই এখন প্রকৃত সাংবাদিকতার ওপর চেপে বসেছে, যার কারণে হারাতে বসেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আদি ধারা। গতকাল (শুক্রবার) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বিদেশি অতিথিরা গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক মুক্ত আলোচনায় এসব কথা বলেন।
বিশ্ব গণমাধ্যমের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে গিয়ে আলোচকদের কেউ কেউ বলেছেন, সাংবাদিকতা এখনো অনেকটাই নগরকেন্দ্রিক। যার কারণে বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত গণমাধ্যমে যথাযথভাবে উঠে আসছে না। এর চরম উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল। যেখানে সব গণমাধ্যমের সব ধরনের পূর্বাভাসকে মিথ্যা করে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
বিশ্বের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ান- ইফরা’র দক্ষিণ এশিয়া শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাগদুম মোহামেদ বলেন, আইনে আমাদের গণমাধ্যমের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সবার নজর দেয়া উচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী চলছে আমরা কী সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি? আমাদের সেদিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। আমাদের মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা করতে হবে।
ভারতের দৈনিক ভাস্কর-এর গ্রুপ এডিটর ও এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দুবে বলেন, প্রত্যেক দেশের সংবিধানে, আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা যখনই বাস্তবায়নের সময় আসে তখনই ক্ষমতাসীনরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রেস কাউন্সিল আছে, সবকিছু আছে। কিন্তু সবকিছুকে এড়িয়ে তারা (ভারত সরকার) তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির সুপারিশে একদিনের জন্য এনডিটিভি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিল।
অস্ট্রিয়াভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) নির্বাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান জন ইয়ারউড বলেন, এ কয়দিন আগেই তিনি তুরস্কে ও জাম্বিয়ায় বিরোধী মতের পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা দেখেছেন। সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, যে কোনো সমাজের জন্যই মুক্ত গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জরুরি।
এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্টের (আইএমএস) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এসবেন কিউ হারবো বলেন, সারা বিশ্বের গণমাধ্যম আজ সংকটে। কারণ বিশ্বব্যাপী পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। গত ১৮ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে এখন ঐক্য খুবই দরকার।
নেপালের দৈনিক কান্তিপুরের প্রধান সম্পাদক সুধীর শর্মা বলেন, নেপালের সংবিধানে মুক্ত গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা আছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যবসায়ী মহল ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয়। বর্তমানে বড় বড় ব্যবসায়ীরা মিডিয়াতে বিনিয়োগ করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য যতটা না সৎ সাংবাদিকতা তারচেয়ে বেশি অন্য স্বার্থ।
ভারতের দৈনিক দ্য হিন্দু’র মুকুন্দ পদ্মনাভন বলেন, ভারতেও পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মামলা দিয়ে হয়রানির ধরনটা বাংলাদেশের মতো। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। ঢাকায় আসার পথে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে বসে একটি ফোন কলে জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে ২০ বছর আগের পুরোনো একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের স্থানীয় প্রশাসনের হুমকির মুখে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত।
ত্রিপুরার দৈনিক দেশের কথার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গৌতম দাশ বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে আমার পত্রিকার ওপর ৫০০ বারেরও বেশি আক্রমণ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে চাপ তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মামলা তো রয়েছেই। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ দায়েরের বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলকে পাশ কাটিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে সংবাদমাধ্যম বন্ধের নজিরও ভারতে রয়েছে। এ সময় তিনি প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
ভারতের মেঘালয়ের ইংরেজি দৈনিক দ্য শিলং টাইমসের সম্পাদক প্যাট্রিসিয়া মুখিম বলেন, ভারতে আইনগতভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সবাই নিজেদের মনের কথা মন খুলে বলতে পারে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতায় দরকার যেখানে আমার মনের কথা আমি মন খুলে বলতে পারব।
সাংবাদিকতা এখনো শহরের গ-িতে সীমাবদ্ধ উল্লেখ করে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতার সিনিয়র সহকারী সম্পাদক স্বাতী ভট্টাচার্য বলেন, মফস্বলের সাংবাদিকতা অনেকটাই জেলা প্রশাসক আর জেলার পুলিশ প্রধানের কার্যালয় নির্ভর। এর বাইরে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা গণমাধ্যমে খুব কমই উঠে আসছে। সাংবাদিকেরা খুব কমই গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। গ্রামের হাসপাতালগুলোতে কী অবস্থা, স্কুলগুলোতে কী পড়ানো হচ্ছে এ বিষয়গুলোকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না।
সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যম নির্বাহীদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বারবারা ত্রিয়োনফি বলেন, ‘আমাদের দেশের (সাধারণভাবে ইউরোপে) এখানে মানুষ গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে না। তারা সাংবাদিকদের কাছে যায় না। তারা যায় রাজনীতিবিদদের কাছে। সাংবাদিকদের সংকটগুলো আমরা জানি।’
ভুটানের জাতীয় দৈনিক কুয়েনসেল-এর সম্পাদক রিনঝিন ওয়াংচুক বলেন, ভুটানে এখন পরিবর্তন আসছে, আগে কোনো সমস্যা হলেই মানুষ রাজার কাছে যেতো। কিন্তু এখন তারা সাংবাদিকদের কাছে যাচ্ছে। এমনকি আদালতে হেরে গেলেও তারা সাংবাদিকের কাছে আসছে।
সেøাভাকিয়ার দৈনিক এসএমইতে কর্মরত সাংবাদিক মাতুস কেরাসিমারিক বলেন, মানবাধিকার প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমগুলোকে দায়িত্ববান হতে হবে।
সাংবাদিকতার ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রধান সম্পাদক রাজ কমল ঝা বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের কারণে সবাই নিজেকে ভাবছে সাংবাদিক। সবার হাতে হাতে ছবি তোলার মতো মোবাইল, যে কেউ যে কোনো কিছু লিখতে পারছে, যা খুব সহজেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের তথ্য যাচাইয়ের বিষয়গুলো দেখতে হবে। আজকের এ যুগে সবার মত আছে। সবাই সে মতটা চাপিয়ে দিতে চায়। তিনি বলেন, টিভিতে কেউ কেউ এসে কথা বলে অনেক বড় তারকা বনে যাচ্ছে। তারা এসে সরকারের পক্ষে কথা বলছেন, তারা এমনও বলছেন যে সাংবাদিকদের (পেশাদার) গ্রেপ্তার করতে হবে। আজকে তারা উন্নয়ন ও জাতীয়তাবাদকে সাংবাদিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।
রাজ কমলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) দক্ষিণ এশিয়া সংবাদ পরিচালক বার্নাত আর্মেঙ বলেন, আমাদের পাঠকদের মাধ্যম পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা আমাদের খবরগুলো দেখছে, পড়ছে। যে চ্যালেঞ্জগুলো এখন তৈরি হচ্ছে সেগুলো মোকাবিলার জন্য ঐক্য প্রয়োজন।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, পৃথিবীজুড়ে সংবাদপত্রের ভাষা হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সাংবাদিকতার আবেগ ও ধরন একই। সমস্যাগুলোও প্রায় একই। তাই এখন সময় এসেছে সংহতির। পারস্পরিক যোগাযোগকে আরও বেশি সুদৃঢ় করার। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য রাখেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন