শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

হাদীস অনুসরণে বিদ্বেষ ও অনৈক্য কাম্য নয়

প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান

ইসলামের সৌন্দর্যই হলো মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ঐক্য ও মমতার বন্ধন গড়ে তোলা। মানুষ এ জন্যই শ্রেষ্ঠ, কারণ তার মধ্যে মমতা ও ভালোবাসা আছে। নম্রতা ও কোমলতা আছে। অর্জন ও বিসর্জনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি আছে। আছে ¯েœহ-আদর এবং শ্রদ্ধা ও সম্মানের উষ্ণ মানসিকতা। এই গুণগুলো আছে বলেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। এ জন্যই তারা আশরাফুল মাখলুকাত। তাইতো মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মানুষকে বার বার এই কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনÑ ‘তোমরা ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে আল্লাহর বান্দা হয়ে বসবাস করো’, ‘তোমরা এক উম্মত হয়ে থাকো’, ‘তোমরা পরস্পরে মতানৈক্যে লিপ্ত হয়ো না।’
সূরা হুজরাতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও। হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যাকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যে নারীকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না...।’Ñ (হুজরাত : ১০-১১)
এই আয়াতগুলোতে মুমিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করা হয়েছে। মুমিনের কাছে মুমিনের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। এমনিভাবে অনেক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাসূল নিজেও সাম্যমৈত্রী, ¯েœহ-ভালোবাসা এবং একতার উৎকৃষ্ট নজির স্থাপন করে গেছেন। এখন এটাই সবচেয়ে বড় আফসোসের বিষয়, যে কুরআন এবং হাদীসে আমাদের ঐক্য ও সম্প্রীতির সবক দেয়া হয়েছে, সেই কুরআন এবং হাদীসকেই আমরা অনৈক্য ও ভেদাভেদের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছি! আমরা ঐক্য ও সৌহার্দ্যরে কথা ভুলে পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হচ্ছি। কাদা ছোড়াছড়ি করছি। এটা আমাদের জাতিসত্তা এবং ঐক্যের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আমাদের দুর্বল করে দিচ্ছে। যা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। এমনটি মোটেই কাম্য ছিল না।
হ্যাঁ এটা সত্য, কুরআন এবং হাদীসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেই দিকনির্দেশনা বোঝার ক্ষেত্রে মানুষের বোধ ও বুদ্ধির তারতম্যের কারণে কিছুটা মতপার্থক্য হতে পারে এবং সেটা নবীযুগেই হয়েছে। রাসূলের একটি নির্দেশকে বুঝের তারতম্যের কারণে সাহাবায়ে কেরামের দুই দল দুই ধরনের আমল করেছেন। পরবর্তীতে এ ঘটনা শোনার পর আল্লাহর রাসূল কাউকেই কিছু বলেননি। আর সাহাবায়ে কেরামও এই মতপার্থক্যের কারণে একদল আরেক দলের প্রতি কটাক্ষ করেননি। পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হননি। অন্য দলের আমলকে অশুদ্ধ ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিদ্বেষ ছড়াননি। এমনিভাবে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সাহাবী বিভিন্ন ধরনের মত দিয়েছেন। একজনের ব্যাখ্যার সাথে আরেকজনের ব্যাখ্যার কোনো মিল নেই। তারপরও এই ভিন্নতা সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁরা একজন অন্যজনের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করেননি।
এটাই আমাদের জন্য শিক্ষা এবং এই শিক্ষার ওপরই পরবর্তীতে তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং ফুকাহায়ে কেরাম আমল করেছেন। তাদের মাঝে কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে মতপার্থক্য হয়েছে, কিন্তু এই মতপার্থক্য কখনোই শ্রেণীবিদ্বেষ, অনৈক্য, সমালোচনা এবং একে অন্যের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়িতে রূপ নেয়নি। এক ইমাম আরেক ইমামের সমালোচনা করেননি। একজন আরেকজনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেননি। তাহলে আমরা কেন আজ কুরআন এবং হাদীসের সেই বিষয়গুলোকে নতুনভাবে উত্থাপন করে নিজের বুঝ ও বুদ্ধিকে সঠিক ও নির্ভুল দাবী করে পরস্পরে বিবাদে জড়াবো? নিজেদের মধ্যে শ্রেণিবিদ্বেষ ও বৈরিতা তৈরী করব? অন্যের আমলকে কল্পনাপ্রসূত বলে নিজের মতকে সহীহ বলে দাবী করব? এটা ইসলামের শিক্ষা নয় এবং এটা কখনোই মুমিনের গুণ হতে পারে না।
বর্তমানে সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমলের দাবিদার কিছু দীনদার ভাই আমাদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করছেন। সহীহ হাদীসের কথা বলে উম্মতকে অনৈক্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। মসজিদে মসজিদে মুসল্লীদের মাঝে বিবাদ ছড়াচ্ছেন। বলা হচ্ছে হানাফী মাযহাবের নামায নাকি সুন্নাহ সম্মত নয়! এটা নাকি কল্পনাপ্রসূত। বলীর পাঁঠা বানানো হচ্ছে হানাফী মাযহাবের ইমামÑ ইমাম আবু হানীফা রহ.-কে। তিনি নাকি হাদীস জানেন না! হাদীস বুঝেন না! অথচ এসবের কোনো দরকার ছিল না। কুরআন-হাদীস নিয়ে ইজতেহাদী মতপার্থক্য সর্বযুগে ছিল এবং তা কেয়ামত পর্যন্তই থাকবে। এতে দোষের কিছু নেই।
একথা মনে রাখতে হবে, ইজতিহাদী মতপার্থক্য উম্মতের ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক নয়। বিভিন্ন মাসআলায় মতভিন্নতা থাকার পরও উম্মাহর ঐক্য অটুট থাকতে পারে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইসলামের সোনালী যুগে বিদ্যমান। একই খলীফার ছায়াতলে থেকে উলামায়ে কেরামের মাঝে মতপার্থক্য হয়েছে, কিন্তু এই মতপার্থক্য তাদের ঐক্যের ভিত বিনষ্ট করতে পারেনি। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এখনও যদি কোনোভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের পথ তৈরি হয় তাহলে সেখানে মাযহাবের ভিন্নতা ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না।
আফসোসের বিষয় হলো, আমাদের আহলে হাদীস ভাইগণ ঠিক এই জায়গায় এসে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তারা ভাবেন, ‘আল্লাহ এক রাসূল এক; মাযহাব কেন চারটা হবে? উম্মাহর মধ্যে চারভাগ কেন হবে? আমরা সবাই একদল হয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসরণ করে ঐক্য গড়ে তুলব। ভাগাভাগির প্রয়োজন নেই।’ তাদের এই ভাবনা ভুল। কারণ এক উম্মতের মাঝে চার মাযহাব হওয়া মানে উম্মতের মধ্যে চারভাগ হয়ে ফাটল সৃষ্টি হওয়া নয়। দুটো কখনোই এক হতে পারে না। তাহলে তো মুসলিম উম্মাহর ঐক্য আদৌ সম্ভব নয় এবং একথা বলারও সুযোগ থাকবে না যে, মুসলিম উম্মাহ নবীযুগ থেকে নিয়ে এই পর্যন্ত কখনো এক ছিল। কারণ বিভিন্ন বিষয়ে মতভিন্নতা সর্বযুগেই ছিল। মুসলিম উম্মাহ যখন একই পতাকাতলে অবস্থান করেছে তখনও ছিল। তাই এই মতভিন্নতাকে অনৈক্যের কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে উম্মাহর মাঝে ফাটল সৃষ্টি করে নতুন কোনো মতবাদ তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্যের পথ তরান্বিত করে এবং আরো বেশি দল-উপদল তৈরি করে। যার বাস্তব উদাহরণ আহলে হাদীস ভাইগণ নিজেরাই। এক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি, শুধু বাংলাদেশেই আহলে হাদীসের ১৬টি গ্রুপ আছে। এখানেও দেখা গেছে, অনেক মাসআলায় তাঁদের এক আলেমের মতের সাথে অন্য আলেমের মতের কোনো মিল নেই। তাহলে সহীহ হাদীস অনুসরণের নামে ঐক্যটা হলো কোথায়! আমরা ঐক্যের নামে উম্মতকে চার মাযহাবের গ-ি থেকে বের করে ষোল দলের গ-িতে আনতে চাচ্ছি! এটা আরো বেশি বিবাদের পথ খুলবে এবং বাস্তবে হচ্ছেও তাই।
অবশ্যই একটা ক্ষেত্রে আমি আহলে হাদীস ভাইদের মন থেকে শ্রদ্ধা করি, তারা যা করছেন সহীহ হাদীস অনুসরণের চেষ্টা থেকেই করছেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই করছেন। এটা খুবই ইতিবাচক। কিন্তু আমার মনে হয়, তাঁদের পথ ও পন্থা ভুল। তাঁরা শাখাগত মাসআলায় ইখতেলাফ ও মতভিন্নতার আদব রক্ষা করতে পারছেন না। দীনের জন্য অন্যের ত্যাগ ও কুরবানীর স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। ইলমের ময়দানে যাদের দান-অনুদান ও শ্রমের বদৌলতে ইসলাম আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে তাঁদের অবদান বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
আমরা চাই পবিত্র কুরআন এবং হাদীস আমাদের ঐক্য ও সম্প্রীতির মাধ্যম হোক। কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মমত্ববোধ অটুট থাকুক। কুরআন-হাদীস অনুসরণের নামে আমাদের মাঝে কোনোভাবেই যেন অনৈক্য না ছড়ায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন