সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

হিজাব নিয়ে কর্নাটক আদালতের প্রশ্নবিদ্ধ রায়

তারেকুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

এ বছরের শুরুতে ভারতের কর্নাটক রাজ্যের একটি সরকারি কলেজে হিজাব ও বোরকা পরা ছাত্রীদের ঢুকতে বাধা দিলে তারা প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী কর্নাটকের উচ্চ আদালতে মামলা করে। তখন উচ্চ আদালত এক অন্তর্বর্তী আদেশে বলেছিলেন, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হিজাবসহ কোনো ধরনের ধর্মীয় পোশাক পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা যাবে না। সেই উচ্চ আদালতের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মামলার রায়ে বলেছে, ‘ইসলামে হিজাব কোনো আবশ্যকীয় বিধান নয়’। আদালতের এ বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। এমনকি একান্ত ধর্মীয় বিষয়ে আদালত কোনো হস্তক্ষেপ করা বা সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার রাখে কিনা তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

উচ্চ আদালতের এই বক্তব্যের প্রথম সমস্যা হচ্ছে, হিজাবকে নিছক পোশাক হিসেবে দেখা। ইসলামে হিজাব ও বোরকা শুধু পোশাক মাত্র নয়, বরং সেটা পর্দার প্রতীক। পর্দার সেন্স থেকে বিষয়টিকে বুঝতে হবে। পর্দার সেন্স বাদ দিলে হিজাব-বোরকা নিছক পোশাকি কালচার বা পোশাকি ফ্যাশনের বিষয়বস্তু হয়ে পড়বে। সে কারণে আকর্ষণীয় টাইটফিট বোরকাও পর্দার মূল্যবোধ ধারণ করতে পারে না। ইসলামে পর্দার উদ্দেশ্য বলতে যা বুঝায়, সেটাই ধর্মীয় মূল্যবোধ হিসেবে হিজাব ও বোরকা পরিধানের উদ্দেশ্য হতে হবে। সূরা আন-নূরে আল্লাহ বলেছেন, ‘ঈমানদার নারীদের বলে দাও- তারা যেন তাদের দৃষ্টি এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌনকামনামুক্ত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে...।’ (আয়াত: ৩১)।

সুতরাং, পর্দার মূল উদ্দেশ্য হলো, অশ্লীলতা ও হারাম কামুক নজর থেকে নারীদের নির্বিশেষে সুরক্ষিত রাখা এবং সমাজে শালীনতা বজায় রাখা। তাই আল্লাহর ফরজ হুকুম ‘পর্দা’ মানার ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের জন্য ওড়না-হিজাব-বোরকা ধর্মীয়ভাবে আবশ্যিক পোশাক। তবে পর্দা শুধু নারীকে করতে বলা হয়েছে এমন নয়। পুরুষকেও চোখের পর্দা তথা দৃষ্টি অবনমিত করে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। সেইসাথে নারী-পুরুষ উভয়কেই স্ব-স্ব লজ্জাস্থানের হেফাজতও করতে বলা হয়েছে।

যাই হোক, নাগরিকদের যেকোনো ধরনের ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধান মেনে চলার স্বাধীনতা ও অধিকার ভারতের সংবিধানে সংরক্ষিত। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী সাংবিধানিক মূলনীতির থোড়াই কেয়ার করে একে একে মুসলমানদের সব অধিকার কেড়ে নিতে চায়। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে তারা এককভাবে হিন্দু মহাভারত কায়েমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে আন্তঃধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সম্পর্ক বিনষ্ট করে ভারতের সামাজিক রূপকাঠামোও ভেঙে দেয়া হচ্ছে। ফলে ভারতে মুসলমানরা দিন দিন নিম্ন শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হচ্ছে।

কর্ণাটক সরকারের হিজাব নিষিদ্ধকরণ আন্তর্জাতিক আইনে বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীনভাবে শিক্ষা প্রাপ্তির অধিকার থেকে হিজাব পরিহিত মুসলিম নারী ও মেয়েদের বঞ্চিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) ভারতে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধকরণ এবং উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে প্রকাশ্যে মুসলিমদের গণহত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই হিজাব নিষিদ্ধকরণ ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে এবং নারী ও মেয়েদের ‘কলঙ্কিত’ ও ‘প্রান্তিকীকরণ’ করেছে। বিশ^খ্যাত বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ভারতে ইসলামোফোবিয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে এবং ২৫০ মিলিয়ন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতিত সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।

পশ্চিমারা নিজেদের উদার ও মানবিক দাবি করলেও মুসলিমদের বেলায় তারা হয়ে পড়ে সঙ্কীর্ণ। জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও নরওয়েসহ বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে হিজাব ও বোরকাকে আইন করে ব্যান করা হয়েছে তাদের তথাকথিত সেকুলার মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থে। এমনকি আইন লঙ্ঘন করলে জরিমানার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অথচ প্র্যাকটিসিং খ্রিস্টান ও ইহুদি নারীরাও মাথায় স্কার্ফ বা হেডকভারিং পরে থাকে। তাদের জন্য কিন্তু সেই আইন প্রযোজ্য নয়। তার মানে, এটা যে সেকুলারিজমের মুখোশে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী আইন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হিজাব ব্যান করার পেছনে ইসলামোফোবিয়া তথা ইসলামবিদ্বেষ মূল অনুঘটক। এছাড়া ইউরোপে হিজাব-বোরকা পরিহিত নারীদের প্রায়ই বর্ণবাদী হামলা ও কটাক্ষের শিকার হতে হয়। কার্যত ব্যাপারটা যেন এমন- উদারতা, মানবিকতা, নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার মুসলমান বাদে আর সব ধর্মাবলম্বীর জন্য সুরক্ষিত!

উগ্র সেকুলারিজম মুসলিম মেয়েদের জন্য নানা ধরনের ক্রাইসিস তৈরি করেছে। বোরকা-হিজাব পরা মুসলিম মেয়েদের প্রতি সেকুলারদের বর্ণবাদী আচরণ খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেকুলার জনপরিসরে তাদেরকে ঘৃণাবশত ‘অপর’ করে দেখা হয়। আমাদের দেশকে বলা হয় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ক্লাসরুমে তথাকথিত প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দ্বারা প্রায়ই হিজাব-বোরকা পরিহিত ছাত্রীরা বর্ণবাদী আচরণ, তিরস্কার ও অসম্মানের শিকার হয়। ওই শিক্ষক-শিক্ষিকারা হিজাব-বোরকায় আইডেন্টিটি ক্রাইসিস খুঁজে পান। অর্থাৎ, হিজাব-বোরকা পরলে বাঙালি পরিচয় থাকে না। যেমনটা দাড়ি-টুপিতে তারা মুসলমানিত্ব দেখে, বাঙালিত্ব দেখে না। এক কথায়, তারা শুধু টিপ, সিঁদুর, ধুতি ও হিন্দু কালচারেই বাঙালিত্ব খুঁজে পান। সেকুলার প্রগতিশীলদের কাছে হিজাব-বোরকা পরা মেয়েরা ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘ভিনদেশি’ হিসেবে বিবেচিত হয়!

২০২০ সালের শেষের দিকে আমাদের দেশে একজন বোরকা পরা মা তার ছেলেকে নিয়ে একটি মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। সেটার একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। তখন সেই ছবি নিয়ে সেকুলার প্রগতিবাজরা বিতর্ক তুলেছিল। বিবিসি বাংলা এ বিষয়ে এক রিপোর্টে লিখেছিল, “মা আর সন্তানের খেলার ওই মুহূর্তটিকে ছাপিয়ে আলোচনা শুরু হয় ওই নারীর পোশাক নিয়ে। ওই নারী বোরকা পরিহিত হওয়ার কারণে অনেকে তার সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তার মধ্যে তারা ‘বাংলাদেশি মা’কে খুঁজে পাননি। অনেকে আবার বলেছেন যে এটা পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের ছবি” (১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, বিবিসি বাংলা)। অথচ ঢাকার পল্টন এলাকা থেকে সেই ছবিটি তুলেছিলেন ডেইলি স্টারের একজন সাংবাদিক। হিজাব-বোরকার প্রতি অসহিষ্ণুতা যে মূলত ইসলামোফোবিয়াপ্রসূত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

একশ্রেণীর নারীবাদী ও প্রগতিশীলরা যুক্তি দিয়ে থাকে যে, হিজাব-বোরকা নারীদের আবদ্ধ বা শৃঙ্খলিত করে পুরুষতান্ত্রিকতা টিকিয়ে রাখে। প্রথমত, পুরুষতন্ত্র বা নারীবাদ- এ ধরনের কোনো ধারণা ইসলামে নেই। অধিকন্তু, এগুলো পাশ্চাত্যপ্রসূত প্রপঞ্চ। ইসলাম নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করে। প্রতিটি সভ্যতা নির্মাণের পেছনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকাও কম নয়। নারীর অবদান ছাড়া কোনো সভ্যতা নির্মিত হতে পারত না। ইসলাম নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখেনি। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘নারীর ওপর যেমন পুরুষের অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২২৮)। ইসলাম ন্যায্যতা তথা হকের কথা বলে। ন্যায্যতা ও উপযোগিতা অনুসারে যাকে যে অধিকার ও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সে সেটা পালন করবে। এভাবেই সভ্যতা ও মানবসমাজ এগিয়ে যাবে। প্রতিভা, যোগ্যতা ও সুযোগ থাকলে হিজাব-বোরকা নারীদের কখনো আবদ্ধ বা পশ্চাদপদ করে রাখতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ায় হিজাব পরিহিত অসংখ্য সফল নারী রয়েছেন। কেউ সংসারে সফল, আর কেউ বাইরে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, মা হিসেবেও কোনো নারীর যে অসাধারণ সফলতার গল্প থাকতে পারে, সেটাকে আড়াল করে রাখা হয় নতুবা স্বীকৃতি দেয়া হয়না। পুঁজিবাদী আধুনিকতা সফলতার চূড়ান্ত মাপকাঠি নয়। তাই নারীর শিক্ষা ও সফলতা পর্দার কারণে বাধাগ্রস্ত হবে- এমন ধারণা একরৈখিক ও সঙ্কীর্ণ চিন্তাপ্রসূত। তাছাড়া হিজাব-বোরকা পরিত্যাগ করলেই নারীমুক্তি ঘটবে- এটাও অতিরঞ্জিত বয়ান। কোরআনে আল্লাহ নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরকরূপে সাব্যস্ত করেছেন (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৭, দ্রষ্টব্য)। সুতরাং, পুরুষতন্ত্রের অজুহাতে নারীমুক্তি ও নারী-স্বাধীনতার জিগির তুলে পুরুষ থেকে নারীকে বিচ্ছিন্ন করতে চাওয়াটা সভ্যতাবিরোধী চিন্তাই শুধু নয়, ইসলাম পরিপন্থিও।

ইসলাম প্রধানত মাহরাম ও গায়রে মাহরামের মধ্যে পর্দার বিধান মানাকে ফরজ করেছে। তা সেটা চাদর, ওড়না, হিজাব ও বোরকা- যেকোনো পোশাকেই হোক। পোশাক মুখ্য নয়। মুখ্য হলো পর্দা। পর্দার বিধানের কারণেই হিজাব-বোরকার গুরুত্ব। পর্দা ইস্যুতে হিজাব-বোরকা পোশাকি ফ্যাশন বা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়। মুসলিম নারীর পোশাকে পর্দার মূল্যবোধ ধারণ করার কথা বলে ইসলাম। উদারনৈতিক বয়ানে হিজাব-বোরকা ব্যক্তিগত পছন্দ, ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা অধিকারের ইস্যু হলেও ইসলামে মেয়েদের জন্য এটি একটি অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় অনুশাসন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tareqislampt@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Ayub ৭ এপ্রিল, ২০২২, ১২:১৬ পিএম says : 0
MashaAllah
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন