শাবান মাস মূলত পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতির একটি মাস। প্রতিবছর শাবান মাস মুসলমানদের কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত রমজান মাসের সওগাত নিয়ে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী সপ্তাহের রোববার বা সোমবার পবিত্র মাহে রমজান শুরু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। হিজরি চান্দ্রবর্ষের নবম মাসের আরবি নাম রমাদান১৪৪৩। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা উচ্চারণে এটি হয় রমজান। রমাদান বা রমজান শব্দের অর্থ হলো প্রচণ্ড গরম, সূর্যের খরতাপে পাথর উত্তপ্ত হওয়া, সূর্যতাপে উত্তপ্ত বালু বা মরুভূমি, মাটির তাপে পায়ে ফোসকা পড়ে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া, কাবাব বানানো, ঘাম ঝরানো, চর্বি গলানো, জ্বর, তাপ ইত্যাদি। রমজানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোজাদারের পেটে আগুন জ্বলে; পাপতাপ পুড়ে ছাই হয়ে রোজাদার নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এ মাসের নাম রমজান। (লিসানুল আরব)।
স্বাগত রমজান:- রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখো।’ (মুসলিম)। নবী করিম (সা.) এভাবে রমজানকে স্বাগত জানাতেন: ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (বুখারি)।
রমজানের চাঁদ দেখা:- হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো (ঈদ করো)।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তাই চাঁদ দেখা সুন্নত; এটি ইবাদতের প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসার প্রতীক। নতুন চাঁদকে হিলাল বলে। প্রথম তিন দিনে হিলাল বা নতুন চাঁদ দেখলে এই দোয়া পড়া সুন্নত: ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান, ওয়াছ ছালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলাম সহযোগে আনয়ন করুন; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪০০, রিয়াদুস সালেহীন: ১২৩৬)।
রমযানের মর্যাদা:- এ মাসে রোযা রাখা আমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে।রোযা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর ফরজ হয়েছে তা না, অন্যান্য নবির উম্মতের উপরও তা ফরজ ছিল। রোযার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংযম-পরহেজগারির মাধ্যমে বান্দার তাকওয়া অর্জন কুরআনে কারীমের ঘোষণা,অর্থ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারা-১৮৩)। রমজান মাস কুরআন নাযিলের মাস। কুরআন যেমন মহা মূল্যবান, রমজানও তেমনি মহামর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালার ইরশাদ, ‘রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
এ মাসটিতে এমন এক রাত রয়েছে, যে রাতে ইবাদত করা হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি উত্তম। রমজান অত্যন্ত বরকতপূর্ণ মাস। এ মাসে রহমতের অঝোরে বৃষ্টি নেমে আসে জাহান্নাম তালাবদ্ধ হয়। শয়তান আটকে পড়ে। প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেন, ‘রমযান মাস আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়।’ (বুখারী : ১৮৯৯)। এ মহান মাসে বান্দার জন্য রহমতের দরোজা খুলে যায়। হাদিসের ইরশাদ,‘রমজান মাস আসলে জান্নাতের দরোজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।’ (বুখারী, ১৮৯৮, মুসলিম, ১০৭৯)
পূর্ববর্তীদের রোজা : এই আয়াতে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো, রোজা শুধু সর্বশেষ উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়নি। অন্য ধর্মের অনুসারীদের ওপরও রোজা পালন করার বিধান ছিল। পৃথিবীর প্রথম নবী আদম (আ.) রোজা পালন করতেন। নুহ (আ.)-এর সময় প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার বিধান চালু ছিল। দাউদ (আ.) তাঁর শিশুপুত্রের অসুস্থতার সময় সাত দিন রোজা পালন করেন। মুসা (আ.) এবং ঈসা (আ.) ৪০ দিন করে রোজা রেখেছেন। আমাদের প্রিয়নবী মোহাম্মদ (সা.) রোজা ফরজ হওয়ার আগে মহররমের নবম ও দশম তারিখ রোজা রাখতেন। হিজরি দ্বিতীয় সালে রমজানের রোজা ফরজ হিসেবে ঘোষিত হয়।তাহলে সহজেই অনুধাবন করা যায়, মাহে রমজানের রোজা পালন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই কেউ কোনো কারণ ছাড়া রোজা না রাখলে সে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য হবে। আর রোজা অস্বীকার করলে সে কাফির হিসেবে বিবেচিত হবে।
রোযাদারের পুরস্কার:- রোযাদারের রোযা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। রোযা লৌকিকতা বিবর্জিত এক আমল। যে আমল রিয়া বা লোক দেখানো থেকে মুক্ত। এজন্য রোযার পুরস্কারও বিরাট। নবীজি সা ইরশাদ করেন..যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।(বুখারী,১৮০২) রোযার ইখলাসে বদৌলতে আল্লাহর কাছে (দীর্ঘ সময় পানাহার না করার কারণে সৃষ্ট) রোযাদারের মুখের দূর্গন্ধ মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয়। রোযা এমন একটা মহান আমল, যার পুরস্কার আল্লাহ নিজ হাতেই দিবেন প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেন, যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ! রোযাদারের (দীর্ঘ সময় পানাহার না করার কারণে সৃষ্ট) মুখের দূর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের (এক প্রকার দামি সুগন্ধি) চেয়েও অধিক প্রিয়। কারণ (আল্লাহ তায়ালা বলেন) রোযাদার কেবল আমার জন্যই পানাহার ও প্রবৃত্তির বাসনায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। রোযা কেবল আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো। (আর প্রত্যেক) সৎকাজের সওয়াবই দশগুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়।(বুখারী: ১৮৯৪, মুসলিম, ১১৫১)।
রোযাদারের বিশেষ দু’টি আনন্দের কথা রাসূল সা বলেছেন,দু’টি আনন্দ রয়েছে, যা রোযাদারকে আনন্দিত করে। এক, যখন সে ইফতার করে। দুই, যখন সে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাত করবে, তখন (আল্লাহ প্রদত্ত) রোযার (প্রতিদানের) কারণে সে আনন্দিত হবে। (বুখারী, ১৯০৪, মুসলিম, ১১৫১)। কিয়ামতের দিন রোযাদারদের বিশেষ সম্মান অর্জিত হবে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘জান্নাতে ‘রাইয়্যান’ নামক একটি দরজা রয়েছে, কিয়ামতের দিন যা দিয়ে শুধু রোযাদাররাই প্রবেশ করবে। রোযাদার ছাড়া অন্য কারোর এ দরজা দিয়ে প্রবেশাধিকার নেই। রোযাদাররা প্রবেশ করার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর আর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারি : ১৮৯৬, মুসলিম : ১১৫২)
রমজানে গুনাহ মাফ : মাহে রমজানের মাস তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম ১০ দিন রহমত, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত এবং তৃতীয় ১০ দিন নাজাতের সময়। রমজান মাসে আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য অশেষ রহমত ও করুণা লাভের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেন। অতীতের সব গুনাহ মাফ পাওয়ার সুযোগ আসে রমজান মাসে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। রমজানের রাতে নামাজ আদায় করে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি)।
রমজানে ওষুধ সেবন:- রমজানের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি অন্যতম। রোজা পালন ও তারাবির নামাজ আদায়ের জন্য এই উভয় প্রকার প্রস্তুতি খুবই প্রয়োজনীয়। যাঁরা নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ সেবন করেন, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ গ্রহণের সময়সূচি নির্ধারণ করে নেবেন। যাঁদের শারীরিক ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে হয়, তাঁদেরও সেই উপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট করে নিতে হবে।
রমজানে প্রয়োজন হালাল ও পুষ্টিকর খাবার:- রমজানে হালাল খাদ্যের আয়োজন করতে হবে; ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবারের বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে।
ইফতার ও সেহরির সুন্নত পালন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি যত্নবান থাকতে হবে, যাতে ইবাদতের অসুবিধা না হয়। ইবাদতের অনুকূল ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সুন্নতি লেবাসের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পরিশেষে, মাহে রমজানের প্রতিটি ক্ষণ আমাদের অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে কাজে লাগানো উচিত। সারা বছরের পাথেয়, এমনকি সারা জীবনের পাথেয় অর্জন করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় রোজা। রোজার মাসে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের যে অনন্য উপহার ঘোষণা করা হয়েছে, তা যেন আমরা যথাযথভাবে লাভ করতে পারি, তার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আমাদের রোজা শুধুই যেন উপবাসের শামিল না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আসুন, রোজার মাসকে স্বাগত জানাই। বলি, ‘সুস্বাগত, হে মাহে রমজান!’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন