মৌসুমী বায়ুমালা অর্থাৎ বর্ষার আগমন এখনও অনেক দেরি। তবে তার আগেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হচ্ছে। বিশেষ করে আসাম ও মেঘালয় প্রদেশে চলতি এপ্রিল মাসের গোড়া থেকেই ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেখানে অতি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গতকাল রোববার দেয়া বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অপর এক বিশেষ আবহাওয়া প্রতিবেদনে আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতে অতিবৃষ্টির ফলে উজান থেকে আসছে ঢল। উজানের ঢলের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আরও ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উজানের ঢলের তোড়ে বাঁধ ভেঙে ক্রমাগত ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। হাওর অঞ্চলের কৃষকগণ এখন দিশেহারা। উজানে অতিবৃষ্টির কারণে চলতি মাসে স্বল্পমেয়াদি আকস্মিক বন্যার শঙ্কার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ কমিটি।
ভারতের উজানের ঢলে ইতোমধ্যে দেশের হাওর অঞ্চলে ব্যাপক ইরি-বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। হাওরের বেশ কয়েক স্থানে ভেঙ্গে গেছে বাঁধ। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে উজানের ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা এবং সিলেটের একাংশে বোরো ফসলের আরও জমি তলিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অতি বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। দেশের উত্তর জনপদেও অতিবৃষ্টি এবং উজানের ঢলে ফল-ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উজানে অতিবৃষ্টির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ভারী বৃষ্টিরও পূর্বাভাস রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় বাড়ছে পানি।
মৌসুমী বায়ুর আগমনের অনেক আগেই উত্তর-পূর্ব ভারতে অতিবৃষ্টি রেকর্ড করা হচ্ছে। গত ১ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় ১২শ’ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আসামও মেঘালয়ের অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে অতিবৃষ্টির সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মৌসুমী বায়ু আগমনের আগেভাগেই উত্তর-পূর্ব ভারতে অস্বাভাবিক বেশি বৃষ্টিপাত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব হিসেবে দেখছে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সূত্র।
অতিবর্ষণের কারণে উজানের ঢলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা জেলায় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর ইরি-বোরো ফসল ডুবে গেছে। এর বেশিরভাগ ফসল পানির নিচেই বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আসাম ও মেঘাললের ঢলে অব্যাহত ঢলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সিলেটের আরও এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। একই অবস্থা তৈরি হতে পারে উত্তর জনপদের রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানে।
দেশের হাওর অঞ্চলের নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গতকাল জানান, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের কতিপয় স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি কতিপয় পয়েন্টে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
নদ-নদীর অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে, পাউবোর পর্যবেক্ষণাধীন ৩৯টি স্টেশনের মধ্যে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ৮টিতে, হ্রাস পাচ্ছে ২৮টিতে এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩টি স্টেশনে। আপাতত কোন নদ-নদী বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে না।
পাউবোর বিশেষ পূর্বাভাস প্রতিবেদন
বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ ও বৈশ্বিক বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থার সর্বশেষ পূর্বাভাসের ভিত্তিতে গতকাল পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বিশেষ পূর্বাভাস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে জানা গেছে, বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলতি সপ্তাহে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল ১০ থেকে আগামী ১৭ এপ্রিল থেকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম (বরাক অববাহিকা) ও মেঘালয় প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ অবস্থায় আগামী ১০ থেকে ১৭ এপ্রিল নাগাদ ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, যদুকাটা, লুভাছড়া, সারিগোয়াইন, ধলগাইন, পিয়াইন, সোশে^রী, ভুগাই, কংস, বাউলাই নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় স্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এরফলে ১৫ থেকে ১৭ এপ্রিলের পরবর্তীতে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার কতিপয় স্থানে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
উজানের ঢলে অসময়ে যমুনা, করতোয়া, বড়াল ও হুড়াসাগর নদীতে গত কয়েক দিনে পানি বৃদ্ধিতে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি, সোনাতনী, গালা ও জালালপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের নিচু জমির কাঁচা ও আধাপাকা ধান সবচেয়ে বেশি ডুবেছে। ফলে এসব নদীর তীরবর্তী ২০০ বিঘা নিচু জমির বোরো ধান ডুবে গেছে। এতে বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক পানির ভেতর থেকে কাঁচা ধান কটে গরুকে খাওয়াচ্ছে। অনেকে আবার আধাপাকা ধান মাড়াই করে কিছুটা চাল বের করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া এ পানি বৃদ্ধির কারণে নদী তীরবর্তী চিল, বাদান ও কাউনির জমি ডুবে কৃৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে এ অঞ্চলের কৃষকেরা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, গোহালা, ধলাই ও চাকলাই নদীতে পানি বাড়তে দেখা গেলেও এবার বেশ আগেভাগেই অকষ্মাৎ অস্বাভাবিকহারে এসব নদীতে পানি বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে প্রায় ১ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়ে যমুনার দুর্গম চরাঞ্চল বড় চামতারা, ছোট চামতারা, বাঙালা, বানতিয়ার, শ্রীপুর, সোনাতুনী, মাকড়া, ধীতপুর, বানিয়াসিঙ্গুলী, দইকান্দিসহ পৌর এলাকার থানারঘাট, চুনিয়াখালীপাড়া, রূপপুর উরির চরের ফসলসহ নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় দেড়’শ বিঘা কাঁচা, আধাপাঁকা ধান, বাদাম, তিল, পটলসহ নানা ফসল নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে কৃষকের বুকভরা আশা ক্রমশঃ হতাশায় পরিণত হচ্ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নদী ভাঙনের তান্ডবলীলাও শুরু হয়েছে। যমুনা অধুষ্যিত সোনাতুনী ইউনিয়নের বড় চামতারা চরের ভাটিতে নতুন করে নদী ভাঙন শুরু হওয়ায় বিস্তৃর্ণ এলাকার ফসলী জমি নদীগর্ভে বিলিন হতে চলেছে।
গতকাল দুপুরে উপজেলার সোনাতুনী ইউনিয়নের লুৎফর রহমানসহ বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, অসময়ে যমুনাসহ নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিপুল পরিমান ফসল পানিতে ডুবে কৃষকের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। নদীতে যে হারে পানি বাড়ছে তাতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে রোপিত অবশিষ্ট বোরো ধান, তিল, বাদাম, পটলসহ বিভিন্ন ফসল কৃষকেরা সঠিক সময়ে ঘরে তুলতে পারবেন কি না তা নিয়েও তাদের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এদিকে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে হঠাৎ ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের নিচু এলাকার কয়েক’শ একর পেঁয়াজের আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন শত শত পেঁয়াজ চাষী। এদিকে কৃষি অফিস জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৮’শ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার চাষ হয়েছে দ্বিগুন।
উজানে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উপজেলার নয়ারহাট, অষ্টমীরচরের বেশকিছু নিচু চর পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে পেঁয়াজসহ অন্যান্য ফসলও। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। অষ্টমীরচর ইউনিয়নের কৃষক মাইদুল, আ. ছালাম, সোনামিয়া, ময়নাল বলেন, কয়েক’শ একর জমির পেঁয়াজ ক্ষেত এখন পানির নিচে এতে ক্ষতি হবে লাখ লাখ টাকা। নয়ারহাটের কৃষক নজরুল, দেলোয়ার বলেন, হাজার হাজার টাকার পেঁয়াজ তোলার আগেই পানিতে ঢুবে গেল। এখন আমরা কি করবো। লাভের জন্য আশায় পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম এখন পুঁজিই পানির নিচে। অষ্টমীরচর ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সোহরাব হোসেন বলেন, হঠাৎ পানি বৃদ্ধির কারনে কৃষকদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এখন পুষিয়ে উঠাই কঠিন হবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার প্রণয় কুমার বিষান দাস বলেন, আমি সরেজমিন ঘুরে দেখেছি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের পেঁয়াজ ক্ষেত তলিয়ে গেছে এতে কৃষকরা ক্ষতিতে পড়বে। তবে আমরা চেষ্টা করব ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন