দি নিউইয়র্ক টাইমস : হিলারি ক্লিনটন তার বিস্ময়কর নির্বাচনী পরাজয়ের জন্য শনিবার এফ.বি.আই পরিচালক জেমস বি. কোমির ঘোষণাকে দায়ী করেছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিনকয় আগে কোমি হিলারির একটি প্রাইভেট ইমেইল সার্ভার ব্যবহার বিষয়ে তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দেন।
বুধবার সকালে ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্র্ণ মন্তব্যে ৩০ মিনিটের কনফারেন্স করে হিলারি ক্লিনটন দাতাদের বলেন, নির্বাচনের ১১ দিন আগে এ তদন্ত বিষয়ে কংগ্রেসের কাছে চিঠি পাঠানোর কোমির সিদ্ধান্ত বিতর্কটিকে খবরে ফিরিয়ে আনে এবং একটি আশাবাদী সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারণার ইতি টানতে তার জন্য বাধার সৃষ্টি করে।
হিলারি বলেন, এ রকম একটি নির্বাচন কেন সফল হয়নি তার বহু কারণ আছে। তিনি বলেন, তবে আমাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে যে কোমির চিঠিতে যে সব সন্দেহ উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন, প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু তা আমাদের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, নির্বাচনের দু’দিন আগে কোমির দ্বিতীয় চিঠিতে তাকে পুনরায় নির্দোষ ঘোষণা করা ছিল আরো বেশি ক্ষতিকর। এ চিঠিতে কোমি বলেন, হিলারি ক্লিনটনের এক শীর্ষ মহিলা সহযোগীর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন স্বামী অ্যান্থনি ডি. ওয়েইনারের কম্পিউটারে খুঁজে পাওয়া নতুন আরো এক গুচ্ছ ইমেইলের পরীক্ষা তার আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ হয়নি যে মিসেস ক্লিনটন গোপন তথ্য নাড়াচাড়া করার জন্য কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হবেন না।
তার প্রচারণা সহযোগীরা বলেন, ইতিবাচক ফলের সম্ভাবনা হিলারির উপর আস্থা না রাখা ভোটারদের রুষ্ট করেছে এবং তারা ভোট কারচুপির আশঙ্কায় ট্রাম্পের দাবি সমর্থন করেছে। বিশেষ করে শহরতলীর দোটানায় থাকা শে^তাঙ্গ মহিলা ভোটারদের ইমেইল জটিলতার কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তারা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনেক রণক্ষেত্র অঙ্গরাজ্যে ভোটে এগিয়ে থাকার পর হিলারি শনিবার দাতাদের বলেন, আমরা পরাজিত হয়েছি, আমাদের সুবিধা পুনরুদ্ধারে চাপ বজায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, দু’টি ছাড়া রণক্ষেত্র অঙ্গরাজ্যগুলোর সবগুলোতে আমরা আবার শীর্ষে রয়েছি এবং যেগুলোতে আমরা হেরেছিলাম তার কয়েকটিতে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে আছি। আমরা অনুভব করছি যে সেগুলোকে আমাদের একসাথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের তাদের পরাজয়ের জন্য নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বিদেশি শক্তিকে দায়ী করার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ২০০৪ সালে জন কেরি তার পরাজয়ের জন্য ওসামা বিন লাদেনের এক ভিডিও টেপকে দায়ী করেন যা নির্বাচনের কয়েকদিন আগে এসেছিল ও সন্ত্রাসের ব্যাপারে ভীতি ছড়িয়েছিল। ২০১২ সালে মিট রমনি দাতাদের বলেছিলেন তিনি হেরেছেন এ কারণে যে প্রেসিডেন্ট ওবামা আফ্রিকান-আমেরিকান, হিস্পানিক ও তরুণ নামের ডেমোক্র্যাটিক স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্রুপগুলোকে উপহার দেয়ার শপথ করেছিলেন।
হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য অনেক বেশি বাস্তব ও শক্ত তথ্যভিত্তিক। নির্বাচন তথ্য সম্বলিত একটি অভ্যন্তরীণ প্রচারণা মেমো বলে যে নির্বাচন দিনের এক সপ্তাহ আগে থেকেই হিলারি ঐতিহাসিক জয়ের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন ঘটনা আমাদের অনেকের জন্য বাধা সৃষ্টি করে যা আমরা পেরুতে পারিনি।
কয়েকটি রণক্ষেত্র রাজ্যে হিলারি অল্পের জন্য হেরেছেন। যখন সকল ভোট গণনা হলো, মনে হচ্ছিল তিনি ২০ লাখেরও বেশি পপুলার ভোটে জয়ী হতে যাচ্ছেন।
এখনো পরাজয়ের জন্য ব্যক্তিগত দায় এড়ানোর মনোভাব কিছু ডেমোক্র্যাটকে ক্রুদ্ধ করেছে। কোমির পদক্ষেপে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ কিছু দাতা ফোনে বলেন, তাদের বিশ^াস যে মিসেস ক্লিনটন ও তার প্রচার দল কিছু পরিহারযোগ্য ভুল করেন যা অগ্রহণযোগ্য বিরোধীদের হাতে নির্বাচনী বিজয় তুলে দিয়েছে। তারা উল্লেখ করেন যে, শে^তাঙ্গ কর্মজীবী শ্রেণির ভোটদাতাদের কাছে হিলারির নির্বাচনী প্রচার দল আগ্রহ সৃষ্টিকারী বার্তা পৌঁছতে পারেনি। তারা কয়েক বছর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হিলারির প্রাইভেট ইমেইল সার্ভার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ও ওয়াল স্ট্রিটে বক্তৃতা করে বহু লক্ষ ডলার আয় করার কথাও উল্লেখ করেন।
ডেমোক্র্যাট দলের কৌশলবিদ নেভাদার সাবেক সিনেটর হ্যারি রিডের সাবেক ঊর্ধ্বতন সহযোগী জিম ম্যানলে সামাজিক মাধ্যম সাইট সাইডওয়্যারে হিলারি ক্লিনটনের দীর্ঘদিনের সহযোগী ও আইনজীবী প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছেন, নরকে ক্লিনটনের স্টাফদের জন্য বিশেষ জায়গা রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন চেরিল মিলস, যারা ইমেইল সার্ভার স্থাপন অনুমোদন করেছিল।
হিলারির প্রচারণা দল তার তার বিজয় সম্পর্কে এত নিশ্চিত ছিল যে, মঙ্গলবার সকালে তার সহযোগীরা প্রচারণা বিমানে শ্যাম্পেন উৎসব করে। কিন্তু পরে সহযোগীরা জানতে পারেন যে, তাদের এ আনন্দের ভিত্তি ছিল ভুল উপাত্ত যাতে দেখানো হয় যে তরুণ, কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনো ভোটদাতারা এবং শহরতলির নারীরা ট্রাম্পের মন্তব্যের কারণে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং হিলারিকে পছন্দ না করলেও তারা এখন অধিক সংখ্যায় তাকেই ভোট দেবেন যা শেষ পর্যন্ত তারা করেননি।
এডিসন রিসার্চ পরিচালিত ভোটদান পরবর্তী জনমত জরিপে দেখা যায়, যারা বলেছেন যে নির্বাচন দিনের আগের সপ্তাহে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের ৪৭ শতাংশ ট্রাম্পকে ও ৪২ শতাংশ হিলারিকে ভোট দিয়েছেন।
বুধবার সকালে নির্বাচনী পরাজয়ের ফলে বিমূঢ় ডেমোক্র্যাটদের হিলারির সহযোগীরা ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন যে, নির্বাচনী প্রচারণার অত্যাধুনিক ডাটা মডেলিং এফ.বি. আই-র বোমা ফাটানো ঘোষণাকে আমলে নেয়নি।
কংগ্রেসের কাছে কোমির চিঠি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিহারের দীর্ঘ ঐতিহ্যের বিরোধী। কিন্তু কোমি সহযোগীদের বলেন যে, ঘটনাটি প্রকাশে বেশিমাত্রায় প্রচারিত হওয়ার ফলে তার আর কোনো পথ ছিল না। জুলাই মাসে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণার এক অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নেন যে এফ.বি. আই. হিলারির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনবে না।
সে সময় তিনি বিশ^াস করেছিলেন যে, তিনি বিষয়টির সমাধান করতে পেরেছেন। ১৯ অক্টোবর লাস ভেগাসে চূড়ান্ত বিতর্কে তিনি এমন বলিষ্ঠ অবস্থানে আত্মপ্রকাশ করেন।
হিলারি বলেন, আমরা যেখানে আছি সেখানে ভালো আছি। কংগ্রেসে কোমির প্রথম চিঠির আগে তিনি বলেছিলেন, বাতাস আমাদের পক্ষে আছে।
ট্রাম্প কোমির চিঠিকে লুফে নেন। নির্বাচনের আগের দিন নেভাদায় ভোটদাতাদের তিনি বলেন, এফ.বি. আই. হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে তাদের তদন্ত পুনরায় শুরু করেছে এবং মিসেস ক্লিনটন যদি জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে যান তাহলে তার সরকারকে অচল করে দেবে। এফ. বি. আই.-র নতুন ইমেইলগুলোর পরীক্ষা কার্যত তদন্ত পুনরায় শুরু করেনি।
ডেমোক্র্যাট পোলস্টাররা পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে সামান্য ব্যবধানে ট্রাম্পের বিজয়কে হিলারির ইমেইল বিষয়ে গুরুত্ব আরোপের কারণে শেষ মুহূর্তে রিপাবলিকান প্রার্থীর প্রতি ব্যাপকভাবে কলেজ শিক্ষিত শহরতলির নারীদের সমর্থনকে দায়ী করেছেন।
শনিবার হিলারি বক্তৃতা দেয়ার আগে তার অর্থ পরিচালক ডেনিস চেং দাতাদের ধন্যবাদ জানান যাদের প্রত্যেকেই কমপক্ষে ১ লাখ ডলার করে দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় উপাত্ত প্রচেষ্টা, রণক্ষেত্র রাজ্যগুলোতে কর্মী প্রেরণ এবং টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন বাবদ প্রায় ১শ’ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।
দাতারা বলেন, কোনো পরিমাণ অর্থই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছলদের লক্ষ্য করে দেয়া ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের তুল্য হতে পারেনি।
নিউইয়র্কের বিশিষ্ট ডেমোক্র্যাট ও মিসেস ক্লিনটনের দাতা জে এস. জ্যাকবস বলেন, আপনাদের সেরা মাঠ কর্মসূচি থাকতে পারে এবং আমরা তা সে বিষয়ে কাজ করেছি, তার কিছুই ছিল না। আপনাদের ভালো বিজ্ঞাপন থাকতে পারে, বড় তহবিল পেতে পারেন এবং আমরা তা পেয়েছিও। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিজয় পেয়েছেন ট্রাম্প।
বুধবার ম্যানহাটানের মিডটাউন হোটেলে নির্বাচন পরবর্তী বক্তৃতার পর থেকে ক্লিনটন মোটামুটি চুপচাপ রয়েছেন। বৃহস্পতিবার হিলারি যখন নিউইয়র্কের চাপ্পাকুয়াতে তার বাড়ির কাছে তার কুকুরকে নিয়ে হাঁটছিলেন তখন ১৩ মাস বয়সী এক কন্যা শিশুর মা তাকে দেখেন। তিনি ফেসবুকে পরাজিত প্রার্থীর ছবি দিলে তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়।
শুক্রবার রাতে দেশব্যাপী এক কনফারেন্স কলে হিলারি স্বেচ্ছাসেবীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি দীর্ঘশ^াস ফেলে বলেন, দেখুন, আমি কোনো মিষ্টি প্রলেপ লাগাচ্ছি না। আমাদের খুব কঠিন দিন পাড়ি দিতে হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন