হ ভেজাল খাবার খেয়ে ১৫ লাখ মা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিয়েছে : পবার গবেষণা প্রতিবেদন হ ক্ষতিকর রং, রাসায়নিক উপাদানে মরণব্যাধি রোগ হতে পারে : অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ হ রমজান এলেই ভেজাল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে : অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম
একলাছ হক : ভেজাল পণ্যের দাপটে ইফতার করাই যেন দায় হয়ে পড়েছে নগরবাসীর। রমজান শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজধানীর সব এলাকার হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে পুরোদমে শুরু হয় বাহারি ইফতার সামগ্রী তৈরির ধুম। নামীদামি অভিজাত রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে এলাকার অলি-গলিতে অবস্থিত ছোট দোকানগুলোতেও তৈরি হয় নানা পদের ইফতার সামগ্রী। এক মাস ফুটপাথের দোকানগুলোতেও বিক্রি হয় বিভিন্ন ধরণের ইফতার সামগ্রী। কিন্তু এসব ইফতার সামগ্রীর বেশিরভাগ দোকানেই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে না। বেশিরভাগ দোকানেই ইফতার সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে পোড়া তেল।
একদিনের তেল দিয়ে দীর্ঘদিন তৈরি করা হয় ইফতার সামগ্রী। এমনকি ইফতার সামগ্রী তৈরিতে পোড়া মবিল ব্যবহারের কথাও শুনা যায়। পোড়া তেলে ভাজা হচ্ছে বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ, কাবাব। জিলাপি মচমচে রাখতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে পোড়া মবিল। বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ ইত্যাদি তেলেভাজা ইফতার সামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় কেমিক্যাল রঙ। রমজানে বেশি মুনাফার আশায় বেড়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের ভেজাল দৌরাত্ম্য। ইফতারেই সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হয়। মুড়ি সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। ফলে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ী চক্র ভোজ্যতেলে সাবান তৈরির পাম অয়েল ও বস্ত্রকলের বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রণ করে বাজারজাত করছে। চক্রগুলো সাবান, বস্ত্রকলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খনিজ তেল (হোয়াইট অয়েল), সাবান তৈরির পাম অয়েল ও পশুর চর্বি আমদানি করে তা ভোজ্যতেলে মিশ্রণ করছে। এগুলো বাজারে সয়াবিন, বিনো ও পাম তেল হিসেবে বিক্রি হয়। আর এসব তেলে তৈরি খাদ্য আহারে মানবদেহে জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম দিচ্ছে। এছাড়াও ভোজ্যতেলের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে এমন সব বিষাক্ত পদার্থ, যা শরীরের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর।
ইফতারে বাহারি খাবারের বেশিরভাগই ডুবো তেলে ভাজা হয়। যেমন-পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, পাকোড়া, কাবাব, জিলাপি ইত্যাদি। এসব খাবার তৈরির জন্য অনেকখানি তেলের প্রয়োজন হয়। বেঁচে থাকা তেলের অপচয় রোধ করতে পরেরদিন আবার অনেকেই তা ব্যবহার করে থাকেন। যা শরীরের জন্য হতে পারে মারাত্মক ক্ষতির কারণ। পোড়া তেল ব্যবহারের ফলে এথেরোস্ক্লেরোসিসও হতে পারে। যা খারাপ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তোলে এবং ধমনীতে বাঁধা সৃষ্টি করে বলে জনান বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া হালিম তৈরিতে যে গোশত ব্যবহার করা হয় তা কতদিন আগের তা বলা মুসকিল। এমনকি আগের দিনের বাসি হালিম বিক্রি করা হচ্ছে পরের দিনও। রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয় খুবই নোংরা অবস্থায়, ধুলা বালির মধ্যে তৈরি করা হয় নানা ধরণের ঐতিহ্যবাহী নামের খাদ্যসামগ্রী। পুরনো ঢাকার চকবাজারে জনপ্রিয় বড়বাপের পোলায় খায় পণ্যটিও তৈরি হচ্ছে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এরমধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডেরও বিধান রয়েছে এ আইনে। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সারা দেশে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের (খাদ্যদ্রব্য) মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এই ৪৩টি পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্যভোগ ও ভোক্তা অধিকার) মো. রেজাউল করিম বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বেইলি রোডে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে গেলে তারা তাড়াতাড়ি খাবার ঢেকে ফেলে। চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বিক্রি শুরু করে। খাবারে ভেজাল মেশানো আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ অভ্যাস পরিবর্তনে নিরন্তর চেষ্টা
চালিয়ে যেতে হবে, আমরা সেটাই করছি।
তিনি বলেন, জীবাণুমুক্ত খাবার পরিবেশনের জন্য খাবারের দোকানের কর্মীদের হাতের গ্লাভস, মাথার ক্যাপ দিয়েছি। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করেন না তারা। অনেকে বলে গরম লাগে, কেউ বলে খারাপ লাগে। ভোক্তাদেরও ব্যবসায়ীদের বলতে হবে খাবার ঢেকে রাখার কথা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিক্রি হওয়া খাবার কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করা কঠিন।
সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, খাবার মুখরোচক করার জন্য অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা হয়। এসব উপাদান মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে। লিভারের সমস্যার পাশাপাশি কিডনির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এসব খাবার। বাড়িতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে বানানো খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে। অনেক উপাদান দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত তৈরি করে এবং দুরারোগ্য রোগ জন্ম দেয়। তাই এসব খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ক্ষতিকর রঙ, রাসায়নিক উপাদান, পোড়া তেল খাওয়ার ফলে পেটে সমস্যা হয়। ধীরে ধীরে আলসার ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব খাবার খেলে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য এসব ভেজাল খাবারের ক্ষতি কয়েকগুণ বেশি। গর্ভের শিশু মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভেজাল খাবারে। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে ভেজাল মেশানো খাবার।
পবিত্র রমজান উপলক্ষে খাদ্য পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, নকল ও নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ রোধ করতে অতিরিক্ত মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম পরিচালনা করে শিল্প মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, রমজান মাসে মানসম্মত খাদ্য ও পানীয়সহ ভোজ্যতেল, সরিষার তেল, ঘি, পাস্তুরিত দুধ, নুডুলস, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, লাচ্ছা সেমাই, সেমাই, পানি, ডেক্সট্রোজ মনোহাইড্রেট এবং ইফতার সামগ্রী বিক্রয় ও বিতরণের ওপর বিএসটিআইয়ের নজরদারি জোরদার করবে। ঢাকা মহানগরীর পাশ্ববর্তী জেলা ও উপজেলায় মোবাইল কোর্ট ও পরিচালনা করা হবে। এছাড়া প্রশাসনের সহযোগিতায় বিএসটিআইয়ের সব বিভাগীয়-জেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিএসটিআইয়ের সব কার্যালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন