এ যেন রণক্ষেত্র। রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী, ফুটপাথের হকার ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাবার বুলেট নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ, অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখায় ভয়াবহ ত্রাসের সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা নূরজাহান মার্কেটের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। চন্দ্রিমা মার্কেটেও ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণ ও পেট্রল বোমার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঢাকা কলেজের ছাত্র ও নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী ও হকাররা প্রতিপক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। দোকান কর্মচারীরা পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে কয়েকজন সাংবাদিককে। তারা ভাঙচুর করেছে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স। পুলিশ দীর্ঘ সময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকলেও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়াল শেল নিক্ষেপ করে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ভূতুড়ে অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। সংঘর্ষে ইটপাটকেলের আঘাতে আহত অন্তত ২২ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে আহত এক কুরিয়ারকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে সংঘর্ষের ফলে দিনভর বন্ধ ছিল নিউ মার্কেট এলাকা ও সাইন্সল্যাব এলাকার যান চলাচল। বন্ধ ছিল নিউ মার্কেট এলাকার ২০টি মার্কেট। সংঘর্ষের কারণে রাজধানী ঢাকা শহরে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। এরই মধ্যে ঢাকা কলেজের ছাত্র হলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আবাসিক ছাত্ররা হল না ছাড়ার ঘোষণা। ছাত্রদের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ইডেন কলেজ, আলিয়া মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
জানা যায়, গত ১৮ এপ্রিল রাতে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র নিউ মার্কেটের একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে খাবার খান। দাম কমবেশি নিয়ে দোকান কর্মচারীদের সাথে তাদের বাগি¦তণ্ডা হয়। তা একপর্যায়ে হাতাহাতিতে রূপ নেয়। তবে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের দাবি, বিনা কারণে তাদের দুই শিক্ষার্থীকে নিউ মার্কেটের দোকান কর্মচারীরা পিটিয়েছে। দুই শিক্ষার্থীর ওপর নিউ মার্কেটের দোকান কর্মচারীদের মারধরের ঘটনার প্রতিবাদে ১৮ এপ্রিল রাতে সংঘর্ষ শুরু হয়। রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া এ সংঘর্ষ দফায় দফায় চলে ভোররাত পর্যন্ত। এ সময় পুলিশ সদস্যদের কখনো নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে; কখনো ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে ছাত্রদের দৌড়ানি দিতে দেখা গেছে। কয়েকটি টিভি চ্যানেল লাইভ সে দৃশ্য প্রচার করেছে। ব্যবসায়ী-ফুটপাথের হকার ও পুলিশ যখন ছাত্রদের ধাওয়া করে পেছনে হটিয়ে দেয়; ছাত্ররা তখন ঢাকা কলেজের গেটের ভেতরে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর ছাত্ররা সুসংগঠিত হয়ে পুনরায় রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় কিছু ছাত্রের মাথায় হেলমেট ও কিছু ছাত্রের হাতে রাম দা-কুড়াল দেখা গেছে। ছাত্রদের মারমুখী অবস্থা দেখে পুলিশ পিছু হটে আসে। মূলত সংঘর্ষের পুরোটা সময় নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ, সাইন্সল্যাব ও এর আশপাশের সড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাতভর সংঘর্ষের পর গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার পর ঢাকা কলেজের সামনে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের জেরে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। একজন ছাত্র আইসিইউতে রয়েছেন এমন খবরে মারমুখী হয়ে উঠেন ছাত্ররা। ঢাকা কলেজের মূল ফটকের ভেতরে থাকা ছাত্রদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন ব্যবসায়ী ও ফুটপাথের হকাররা। অন্যদিকে ঢাকা কলেজের ভবনের ছাদ থেকে নিউ মার্কেটের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। উভয় পক্ষের মধ্যে দিনভর চলে থেমে থেমে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় নিউ মার্কেট ও সাইন্সল্যাব এলাকাসহ আশপাশের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পথচারীদের মধ্যে।
নিউ মার্কেট থানার পরিদর্শক অপারেশনস হালদার অজিত ঠাকুর সাংবাদিকদের বলেন, নিউ মার্কেটসহ আশপাশ এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় অবস্থান করছে। দোকান কর্মচারীরাও বিচ্ছিন্নভাবে আছে। দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, আগের রাতের সংঘর্ষের পর সব পক্ষকে শান্ত করে রাত ৪টার দিকে আমরা বাসায় ফিরেছিলাম। আমরা ছাত্রনেতাদের কথা দিয়েছিলাম যে, ব্যবসায়ীরা আর সংঘর্ষে জড়াবে না। কিন্তু সকালে ছাত্ররা আবার সড়ক অবরোধ করে। ফলে পাশে চাঁদনীচক, গাউছিয়া ও অন্যান্য মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আবার একত্রিত হয়ে সংঘর্ষে জড়ায়।
শিক্ষার্থীরা জানান, রাতের সংঘর্ষের সময় আহতদের মধ্যে দুই শিক্ষার্থীসহ চারজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেয়া হয় ও একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কলেজের শিক্ষকরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সমঝোতার লক্ষ্যে রাস্তায় নামলে ব্যবসায়ীরা তাদের হেনস্তা করেন। ফলে তারা ফিরে যান। অপর একজন ছাত্র বলেন, এখন অবস্থা খুব খারাপ। মোশাররফ নামের একজন ছাত্র মুমূর্ষু অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন। এছাড়া আরো অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় সকল ছাত্র বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।
নিউ মার্কেট মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য রাজ্জাক জানান, মূল সড়ক বন্ধ থাকায় যানবাহনকে ঘুরে যেতে হচ্ছে। তাতে আশপাশের সব সড়কে চাপ পড়ছে। নীলক্ষেতের দিকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ফুটপাথের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, আগের রাতের ঘটনার রেশ ধরে মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে নিউ মার্কেটের বিভিন্ন দোকানের কর্মী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এর ফলে এই এলাকায় থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এটিএম বুথসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এই সংঘর্ষে দু’পক্ষেরই অনেক ক্ষতি হয়েছে।
ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ বলেন, সাংবাদিকসহ নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী, কলেজের শিক্ষার্থী মিলে প্রায় শতাধিক আহত হয়েছেন। এছাড়া, সায়েন্সল্যাব থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত সব ধরনের দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। মিরপুর সড়কে যান চলাচলও বন্ধ রয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া, না হলে ঘটনা আরো বড় হতে পারে।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাতে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র নিউ মার্কেটের একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে খাবার খেতে এসেছিলেন। খেয়ে তারা টাকা না দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন। এ নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে দোকানের লোকজনের তর্কাতর্কি হয়। এরপরই ঢাকা কলেজের ছাত্ররা এসে দোকান ভাঙচুর করতে থাকেন। পরে ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে বের হয়ে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগের রাতে যেন পুলিশ সদস্যরা দীর্ঘ সময় ব্যবসায়ীদের পাশে নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। রাত তিনটার দিকে ছাত্ররা ঢাকা কলেজের গেটের ভেতরে চলে গেলে পুলিশ ঘোষণা দেয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পরের দিনও পুলিশ এসে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দুই পক্ষকে রাস্তা থেকে সরে যেতে বলে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোঁড়ে। এ সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশের সাঁজোয়া যান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তারা। ছাত্রদের একটা অংশ ঢাকা কলেজের বিভিন্ন বহুতল ভবনের ছাদে জড়ো হয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। অন্যদিকে মার্কেটের আগুনের কুণ্ডলী ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারীরা ছাত্রদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশকেও ছাত্রদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুঁড়তে দেখা যায়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপে বাধা দেয়নি। মুহুর্মুহু রাবার বুলেট টিয়ার শেল ও ককটেলের শব্দে এ সময় পুরো নিউ মার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
গতকাল সকালে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ দিনের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। দুপুরের পর ৫ মে পর্যন্ত সকল আবাসিক হল বন্ধের ঘোষণা দিয়ে ছাত্রদের বিকেলের মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হল ও ক্যাম্পাস বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, যেকোনো মূল্যে আবাসিক হল এবং ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন। ঢাকা কলেজের শহীদ আ. ন. ম নজিব উদ্দিন খান খুররম অডিটোরিয়ামে সম্মিলিতভাবে ছাত্রনেতারা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের কথা জানান। এ সময় শিক্ষার্থীরা কলেজ প্রিন্সিপ্যাল অপসারণসহ ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনার বিচারের দাবিতে সেøাগান দেন। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফুয়াদ হাসান বলেন, প্রয়োজনে আমরা লাশ হয়ে বের হব। তবু হল-ক্যাম্পাস ছাড়ব না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা চালানো হয়েছে এ ঘটনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
কুরিয়ারকর্মীর মৃত্যু : নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে আহত এক কুরিয়ার সার্ভিসকর্মী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। নিহতের নাম নাহিদ (১৮)। গতকাল মঙ্গলবার রাত রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।
নিহতের স্ত্রী ডালিয়া আক্তার জানান, নাহিদ বাটা সিগনাল এলাকায় কুরিয়ার সার্ভিসের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতেন। মঙ্গলবার সকালে কামরাঙ্গীরচর দেওয়ানবাড়ী এলাকার বাসা থেকে তিনি কর্মস্থলে আসেন। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বামী নাহিদের হাসপাতালে ভর্তির সংবাদ পান। তিনি জানান, নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় আহত অবস্থায় নাহিদ রাস্তায় পড়ে ছিলেন।
মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ : ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। মোবাইল অপারেটর সূত্র জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সোয়া চারটার পর এই সেবা বন্ধ হয়ে যায়। অপারেটর সূত্র জানিয়েছে, সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর ওই এলাকায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা নেয়া হলো।
ইডেনের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন তারা। গতকাল বিকেলে ইডেন মহিলা কলেজের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, ঢাকা কলেজ যৌক্তিক সব আন্দোলন-সংগ্রামে সবার আগে থাকে। এ সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান তারা।
আহত ১১ সাংবাদিক : রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের চলমান সংঘর্ষে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১১ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আহত সাংবাদিকরা বলছেন, সংঘর্ষে জড়ানো দু’পক্ষের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আরচণেরও শিকার হয়েছেন তারা অনেকে। আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন- আজকের পত্রিকার রিপোর্টার আল আমিন রাজু, ডেইলি স্টারের ফটোগ্রাফার প্রবীর দাস, ঢাকা পোস্টের সিনিয়র রিপোর্টার জসীম উদ্দীন মাহি, মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার ইকলাচুর রহমান, দীপ্ত টিভির রিপোর্টার আসিফ সুমিত, এসএ টিভির রিপোর্টার তুহিন, ক্যামেরাপারসন কবির হোসেন, আরটিভির ক্যামেরা পারসন সুমন দে, মাই টিভির রিপোর্টার ড্যানি, জাগো নিউজের রিপোর্টার তৌহিদুজ্জামান তন্ময় ও মানবজমিনের ফটোসাংবাদিক জীবন। এর মধ্যে দৈনিক আজকের পত্রিকার রিপোর্টার আল আমিন রাজু ও ডেইলি স্টারের ফটোগ্রাফার প্রবীর দাসকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়েছে হেলমেটধারী দোকান কর্মচারীরা।
ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল অবরুদ্ধ : ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল প্রফেসর এ টি এম মইনুল হোসেনকে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিকালে প্রিন্সিপ্যালকে অবরুদ্ধ করেন তারা। এ সময় ‘ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন? প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’, ‘অদক্ষ প্রিন্সিপ্যাল মানি না মানব না’সহ নানা সেøাগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, পুলিশি হামলায় প্রশাসন এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
২০ মার্কেট বন্ধ : সংঘর্ষের কারণে নিউ মার্কেট এলাকার অন্তত ২০টি মার্কেটের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। এতে দিনে অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ঈদ কেনাকাটার ভর মৌসুমে এমন ঘটনা দুঃখজনক। দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর করোনার কারণে ঈদের বেচাকেনা হয়নি। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এবার ঈদকে কেন্দ্র করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে নিউ মার্কেট এলাকার সংঘর্ষের সমাধান না হলে তাদের শত কোটি টাকার লোকসান হবে। পাশাপাশি ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চলমান সংঘর্ষের মধ্যেই ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে মিছিল বের করেছেন সরকারি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাজধানীর বকশিবাজার থেকে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের ‘ঢাকা কলেজ, ঢাকা আলিয়া, ভাই ভাই, ভাই ভাই/আমরা যাচ্ছি তোমরা চল, ঢাকা কলেজ রক্ষা করো/ঢাকা কলেজের ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ সেøাগান দিতে দেখা যায়।
তোপের মুখে লেখক ভট্টাচার্য : ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এরই মধ্যে গতকাল বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা কলেজে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। এ সময় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। লেখক ভট্টাচার্য ঢাকা কলেজে পৌঁছলে শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে থাকেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ঢাকা কলেজ সারাজীবন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে প্রটোকল দিয়ে আসছে অথচ ঢাকা কলেজকে বারবার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি থাকলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। পরে ঢাকা কলেজের আবাসিক হল এলাকা থেকে প্রশাসনিক ভবনে আসেন লেখক। ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যালের কক্ষে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল প্রফেসর এ টি এম মইনুল হোসেনসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। তবে নতুন করে আর কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যেন না ঘটে, এর নিশ্চয়তা চেয়েছেন তারা। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে যান ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতির কাছে এ নিশ্চয়তা চান ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা।
মার্কেটের দোকানে আগুন : সংঘর্ষের সময় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়েছে নুরজাহান মার্কেটের একটি দোকান। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা প্রত্যক্ষদর্শীদের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা দেড়টার দিকে এই দোকানে আগুন লাগে। এতে মার্কেটের নিচ তলার সর্বদক্ষিণের কাপড়ের দোকানটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেখানে থাকা দোকানদারদের অভিযোগ, তারা জরুরি সেবায় কল দিয়েও ফায়ার সার্ভিসের সাড়া পাননি।
রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স আক্রান্ত : ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ঘটনায় একটি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে এ ঘটনা ঘটে। সরেজমিনে দেখা যায়, একজন আহত ২৫-৩০ বছর বয়সী রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্সটি। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা কলেজের আহত একজন শিক্ষার্থী ছিল। সেটি ভাঙচুর করেছেন ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীরা। তবে এ অভিযোগের বিষয়ে অপর পক্ষের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ব্যাংক-এটিএম বন্ধ : সকাল ১০টার পর থেকে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন দোকানের কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এর ফলে এই এলাকায় থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এটিএম ব্যুথসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।
পথচারীদের দুর্ভোগ : একদিকে সংঘর্ষ, অন্যদিকে যানজটে চরম দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। ঢাকা কলেজ সংলগ্ন সিটি কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করেছেন। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে সায়েন্স ল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড ও নীলক্ষেত ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
সিটি কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজ থেকে বাসায় ফেরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। মতিঝিল যেতে হবে। কিন্তু যাওয়ার জন্য গাড়ি পাচ্ছি না। ভয় লাগছে, আজ কিভাবে বাসায় যাব।
পুলিশের বক্তব্য : রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা গুলি করে নিয়ন্ত্রণ করা বুদ্ধির কাজ না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। বাস্তবে ঘটনাটা জটিল অবস্থা ধারণ করেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল সচিবালয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ ও যানজটমুক্ত রাখাসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
সংঘর্ষের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ছাত্রদের মোকাবিলা করার সময় আমাদের বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা লাগে। এটা সাধারণ কোনো বা মাস কোনো (গণ) গ্যাদারিং নয় যে গুলি করে তাদের সরিয়ে দিলাম। ছাত্ররা তাদের ১০ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছে। তিনি বলেন, এদিকে তাদের প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীদের বুঝিয়ে মার্কেটে ঢোকানোর চেষ্টা করছি। আইজিপিও কথা বলেছেন ডিসির সঙ্গে। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো একটা পক্ষকে নিবৃত্ত করা। কিন্তু আশপাশের সব শ্রমিক (ব্যবসায়ী) নেমে পড়েছেন। এখান থেকে ঘটনাটা যত সহজ মনে হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটা জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। এখানে শুধু নিউ মার্কেট নয়, চার পাশের সব মার্কেটের লোকজন বা শ্রমিকরা নেমে পড়েছেন, যেখান থেকেই খবর পাচ্ছি সেখানেই পুলিশ পাঠাচ্ছি। টেকনিক্যাল কারণে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ সফট আচরণ করছে। সাধারণভাবে গুলি করে শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বুদ্ধির কাজ নয়। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন