সারাদেশে কালবৈশাখী ঝরে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৪ জনের মৃতু হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সন্দীপে শিশুসহ ২জন এবং বগুড়ায় গাছের ডাল পড়ে ১জনের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষীপুরের রায়পুরে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় গাছের নিচে চাপা পড়ে রুহুল আমিন (৬২) নামের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নে কালবৈশাখী ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে রিনা আক্তার (৪০) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে কালবৈশাখীর ঝড়ে গাছচাপায় সিএনজি চালিত অটোরিক্সার যাত্রী শিশু মিয়া (৬১) নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছে।
গতকাল ভোরে রাজধানীতে হঠাৎ আকাশ কালো করে কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হয়। ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরীরর অনেক রাস্তা ঘাট। এতে সকালে অফিসগামী মানুষ এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তবে রাজধানী ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোন খবর পাওয়া যায়নি।
বগুড়া ব্যুরো জানায় : বগুড়ায় কালবৈশাখী ঝড়ের সময় মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়লে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফসলি জমির বোরো ধান ও আমসহ বিভিন্ন ফসলের। নিহত রেজাউল হোসেন নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটগ্রামের মৃত এছার উদ্দিনের ছেলে।
গতকাল ভোরে বগুড়া জেলার উপর দিয়ে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। ভাটগ্রাম ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড সদস্য কামরুজ্জামান জানান, ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে রেজাউল ও তার স্ত্রী বাড়ির উঠানে গোবর দিয়ে তৈরি করা লাকড়ি ঘরে উঠাচ্ছিলেন। এ সময় সজিনা গাছের একটি মোটা ডাল ঝড়ে উড়ে এসে রেজাউলের মাথায় পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। অপরদিকে ঝড় ও ভারি বৃষ্টিতে জেলার বিভিন্ন স্থানে আধা-পাকা বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নন্দীগ্রাম উপজেলায়। এই উপজেলায় কাটা মাড়াই শুরু হওয়া পাকা ধান মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেই সঙ্গে আম ও লিচুর গুটি ঝরে পড়েছে।
বগুড়া আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসেন জানান, ভোর ৪টা ২২ মিনিট থেকে ঝড় এবং বৃষ্টিপাত শুরু হয়। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত হয় সকাল ৭টা ১২ মিনিট পর্যন্ত। এ সময় ২৩ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, বৈশাখের শুরুতে নওগাঁর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কালবৈশাখীর তান্ডব। প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে হয়েছে বৃষ্টি। মঙ্গলবার রাত ৩টায় এবং বুধবার সকাল ৬টায় দু’দফায় জেলার ওপর দিয়ে ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছে। এতে ইরিবোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ো বাতাস স্থায়ী ছিলো প্রায় আধা ঘণ্টা। প্রচন্ড ঝড়ের পর শুরু হয় বৃষ্টি। ঝড়-বৃষ্টিতে ধান ও সবজি জাতীয় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ঝড় বৃষ্টিতে পাকা ও আধাপাকা ধানের ক্ষতি হলেও যেসব ধান এখ বের হচ্ছে তার জন্য উপকার হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ধান কাটা মাড়াই শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন কিছুটা দেরি হবে। বৃষ্টিতে মাঠের নিচু জমিতে পানি জমেছে। ধান জমিতে শুয়ে পড়ায় ধান চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার মান্দা উপজেলার ভারশোঁ গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, তিন বিঘা জমিতে জিরাশাইল ধানের আবাদ করেছিলাম। আগামী এক সপ্তাহ পর কাটা মাড়াইয়ের কথা ছিল। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টিতে জমিতে সব ধান শুয়ে পড়েছে। বিঘাপ্রতি যেখানে ২৪-২৫ মণ ফলন পাওয়ার কথা ছিল সেখানে বিঘা প্রতি ২-৩ মন ফলন কম হবে। এছাড়া ধান কাটতেও শ্রমিক খরচ বেশি হবে বলে জানান তিনি।
মুরাদনগর (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, মুরাদনগরে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে গাছের নিচে চাপা পরে শিশু মিয়া (৬০) নামে এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। আর এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫জন। বুধবার সকাল সাড়ে নয়টায় উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানাধীন সলফা গ্রামের রামচন্দ্রপুর-শ্রীকাইল সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ উপজেলায় সকাল থেকে হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়।
নিহত শিশু মিয়া উপজেলার পূবধইর-পূর্ব ইউনিয়নের খোশঘর গ্রামের মৃত. নায়েব আলীর ছেলে। আহতরা হলো, উপজেলার সরেরপাড় গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে চালক সবুজ মিয়া (২৫), পার্শ্ববর্তী বাঞ্চারামপুর উপজেলার নীলখী গ্রামের কাওছার মিয়ার মেয়ে ফাতেমা (১৮), নিহত শিশু মিয়ার দুই মেয়ে নার্গিস বেগম (৩৫), জুলেখা বেগম (৩৮) ও নাতী মো: হোসাইন (৩)। পুলিশ ও নিহতের পরিবার সুত্রে জানা যায়, পারিবারিক কাজে নিহত শিশু মিয়া তার পরিবারের লোকজন নিয়ে বুধবার সাড়ে নয়টার দিকে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর-শ্রীকাইল সড়ক হয়ে রামচন্দ্রপুর ফেরী ঘাট এলাকায় যাচ্ছিল। এ সময় সিএনজি টি সলফা গ্রামে পৌছা মাত্র হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় আরম্ভ হয়। এসময় সড়কের পাশে থাকা একটি গাছ ঝড়ে ভেঙ্গে সিএনজি চালিত অটোরিকশার উপর পরলে গাছের নিচে চাপা পড়েন ও অটোরিকশার সকল যাত্রী। এসময় সিএনজিতে থাকা শিশু মিয়ার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় এবং চালকসহ পাচঁ যাত্রী আহত হয়। আহতদের মধ্যে শিশু হোসাইনকে মূমুর্ষ আহত অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। অন্যদের মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানান, ঝড়ো হাওয়া এবং শিলের আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষীদের স্বপ্ন। মঙ্গলবার শেষ রাতে বৈশাখের প্রথম শিলাবৃষ্টি হয়। এতে রংপুরের বিভিন্ন স্থানে আম ও লিচুসহ বিভিন্ন ফসল ও আধা-পাকা ঘর বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিলের আঘাতে আম ও লিচু গাছ থেকে ঝরে পড়েছে আম ও লিচু। শত শত ঘরের টিনের চালা ফুটো হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে পিয়াজ, রসুন, ধান ও ভুট্টাসহ প্রায় সব ফসলের।
রাতে সেহরির পূর্ব মুহুর্তে জেলার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক ঝড়ো হাওয়া এবং শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপি চলতে থাকে ঝড়ো হাওয়া। সে সাথে শিলাবৃষ্টি। আধা ঘন্টাব্যাপি চলমান ঝড়ো হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে শিলাবৃষ্টি। শিলগুলো বেশ বড় এবং ওজনে প্রায় ২০ থেকে ৩০ গ্রাম হওয়ায় বেশিরভাগ গাছের ডাল ভেঙ্গে যায়। এবং বৃষ্টির মত গাছের পাতা ও আম ঝরে পড়ে। আমের সাথে লিচু গাছেরও একই অবস্থা হয়। আম ও লিচুর পাশাপাশি বিভিন্ন রবিশস্যসহ সব ফসলেরই ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগাম জাতের আমন ক্ষেতগুলো বাতাশে মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। আর শিলের আঘাতে ধানের শিষ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে গেছে। বিশেষ করে হাঁড়িভাঙ্গা আম খ্যাত জেলার দু’টি উপজেলা মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ এবং সদরের বিভিন্ন স্থানে হাঁড়িভাঙ্গা আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির পর আম বাগানে গিয়ে বাগানের অবস্থা দেখে অনেক বাগান মালিক অঝোরে কেঁদেছেন। গতকাল সকালে মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুর, ভুরারঘাট, পালিচড়া ও পদাগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন আম বাগান ঘুরে দেখা গেছে বাগানগুলোর গাছের পাতা আর ছোট ছোট আমের স্তুপ। বাগান মালিকরা ঝাড়ু দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছেন। এ সময় বিভিন্ন বাগান মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০/১২ বছরের মধ্যে এমন শিলাবৃষ্টি হয়নি।
এত বেশি শিল পড়েছে যে মাটি পর্যন্ত ঢেকে গিয়েছিল। অনেক বড় বড় শিল পড়েছে। একেকটি শিলের ওজন প্রায় ২০ থেকে ৩০ গাম হবে। বড় বড় শিলের আঘাতে শত শত ঘরের টিন ফুটো হয়ে গেছে।
গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় গতকাল ফজরের নামাজের পর থেকেই ১৫টি ইউনিয়নে কালবৈশাখী ঝড়ে পাকা ও আধাপাকা বোরোধানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গাছপালা উপড়ে পড়ে গেছে। আম, কাঠাঁল, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া বেগুন, শশাসহ তরিতরকারি ফসল নষ্ট হয়ে গছে। স্থানীয় মো. মেহেদী হাসান ওরফে সজিব জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে বোরোধানের নজিরবিহীন ক্ষতি হয়েছে। তবে এবার ভাল বোরো ধান হয়েছিল। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস করার কিছু নেই। উপজেলা সদরের বাহিরে ১৫টি ইউনিয়নে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন র্বোড (পিডিবি) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (আরএবি) আওতাভুক্ত এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় ফলে জনসাধারণের দুর্ভোগ চরমে । বিদ্যুৎ না থাকায় রমজান মাসে রান্নাবান্না ও মসজিদে নামাজ আদায় করতে সমস্যা হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, রায়পুরে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় গাছের নিচে চাপা পড়ে রুহুল আমিন (৬২) নামের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার মধ্য কেরোয়া এলাকায় গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। তিনি ওই গ্রামের মাঝি বাড়ির মৃত শফি উল্যার ছেলে। বৃদ্ধের ছেলে বিলাল হোসেন জানান, সকাল অনুমান আটটার দিকে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে সংলগ্ন দোকানে যান। ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকেন। তাঁদের বাড়ির পাঞ্জেগানা মসজিদের সামনে পাকা সড়কের কাছে আসলে একটি নারিকেল গাছ পড়লে তিনি তার নিচে চাপা পড়েন। গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নে কালবৈশাখী ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে রিনা আক্তার (৪০) নামে এক গৃহবধুর মৃত্যু হয়েছে। সকালে উপজেলার কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড ঝরঝরি নামক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত রিনা আক্তার ওই এলাকার মোঃ শাহ আলমের স্ত্রী। তার ২ ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ এনামুল হক জানান, খবর পেয়েছি সকালে উত্তর কাঞ্চননগরের ঝরঝরি এলাকার মো শাহ আলমের স্ত্রীর গরু আনতে গেলে মাথায় গাছের ডাল ভেঙে পড়লে গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন