বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ন্যায্যমূল্যের নামে প্রতারণা

ঈদের কেনাকাটায় ঢাকার মার্কেট-শপিংমলে ঠকছেন ক্রেতারা নামিদামি ব্র্যাণ্ডের কাপড়েও প্রকৃত দাম আড়াল করে অধিক মূল্য লিখে রাখা হচ্ছে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার পেছনে ছুটে নৈতিকতা হারিয়েছেন

মো. জাহিদুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৫ এএম

রোজা আর ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে যেন প্রতারণার মহোৎসব চলছে। রোজাদারদের সেহরি, ইফতারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পণ্যের মূল্য কয়েক দফায় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকায় কর্মরত পেশাজীবীরা পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে যাবেন বাস-লঞ্চ্যের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পড়বেন প্রতিটি কাপড়ের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু দাম বৃদ্ধিই নয় নামীদামি মার্কেটের দোকান এবং ব্র্যান্ডেড দোকানে ন্যার্য্য মূল্যের নামে কাপড়ে প্রকৃত দাম উঠিয়ে কয়েকশ টাকা বেশি দাম লিখে রাখা হয়েছে। এভাবেই ক্রেতাদের পটেক কাটা হচ্ছে। এ যেন প্রতারণার মহোৎসব চলছে।

কাপড় ব্যবসার নামিদামি প্রতিষ্ঠান। বহু বছর ধরে ‘এক রেটে’ কাপড় বিক্রি করা হয়। অথচ ঈদ উপলক্ষ্যে বেশি ক্রেতা চাহিদার সুযোগে অধিক লাভের জন্য অতিরিক্ত রেটের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মধ্যম সারির দোকান এবং বিপনি বিতানেও ব্যবসায়ীদের একই অপকাণ্ড দেখা গেছে। কম দামের কাপড়ে কোনোটার ভিতরে ট্যাগে প্রকৃত মূল্য লেখা থাকলেও উপরে অতিরিক্ত দাম লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোনোটির নতুন দাম লিখে পুরনো দাম কালি দিয়ে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবেই রাজধানীর মার্কেট ও বিপনি বিতানগুলোতে ক্রেতা ঠকানো হচ্ছে ঈদের কেনাকাটায়। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমান আদালত হাতেনাতে ধরে অনেকগুলো দোকানের জরিমানাও করেছে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ উপলক্ষ্যে ভোক্তাদের ঠকানোর এই অভিনব প্রতারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে জামা-কাপড় কিনে ভুক্তোভোগীরা ব্যবসায়ীদের নানান গালিগালাজ করছেন।

জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফার পেছনে ছুটছে। তাদের মধ্যে যে নৈতিকতা থাকা দরকার তা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না। তবে ভোক্তা অধিদফতরের সাম্প্রতিক অভিযানে বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এই অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। পণ্যের মান, ভেজাল, নকল পণ্য ইত্যাদি প্রতিরোধে আইন আছে। তবে মুনাফা নির্ধারণেও যুগোপযোগী আইন থাকা দরকার।

রাজধানীর মিরপুর বেনারসী পল্লীতে মিতু কাতান শাড়ি ঘরে ১৭০০ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে ১৭ হাজার টাকায়। গোপন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৬ এপ্রিল সেখানে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। একই জায়গায় ও তাওছিফ বেনারসি ফ্যাশনে তদারকি করে দেখা যায়, তাদের কাছে কোনো ক্রয় রসিদ নেই। ক্রেতাকে বিক্রয় রসিদও দেওয়া হয় না। শাড়িতে দেওয়া স্টিকারে এসএল নম্বর ও কোড দেওয়া থাকলেও কোনো মূল্য লেখা নেই। এসএল অনুযায়ী বালাম বই চেক করে দেখা যায়, ইচ্ছেমতো ক্রয়মূল্য লিখে রেখেছেন বিক্রেতারা। ক্রয়মূল্যের পক্ষে কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেননি তারা। পরে জরিমানা করা হয় অনেক দোকানকে।

ভোক্তা অধিকারের অভিযানে অস্বাভাবিক মূল্য আদায় করার প্রমাণ পাওয়া গেছে রাজধানীর নিউমার্কেট, হকার্স মার্কেস, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমন্ডি, সাইন্সল্যাব, জিগাতলা এলাকায়ও। পোশাকের দাম কমানোর প্রতারণামূলক লোভনীয় অফার, যৌক্তিক দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম নেওয়া, দামি ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করাসহ নানাভাবে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। সব ধরনের পণ্যেই এ ধরনের শত রকমের চাতুরতা দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে ঘিরে এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

ঈদকে সামনে রেখে মূল্যছাড়ের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিক্রি বাড়াতে লটারি, বিশেষ ছাড় কিংবা ফ্রি উপহার দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছেন দোকানিরা। নগরীর ছোট-বড় শপিংমল, মার্কেট, বিপণী বিতানে চলছে বিশেষ ছাড় ও নগদ মূল্যছাড়। কেউ দিচ্ছেন একটা কিনলে একটা ফ্রি। দেয়া হচ্ছে লাকি কুপন, স্ক্র্যাচ কার্ড; যাতে পুরস্কার হিসেবে থাকছে সোনা, হীরা, গাড়ি, ফ্ল্যাট, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেলসহ অস্যংখ্য পুরস্কার। কিন্তু বাস্তবে এমন মূল্যছাড় বা পুরস্কার আদৌ কেউ পান কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকেরই।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিউমার্কেট ও এর আশেপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই একাধিক বৈঠক করেন বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। সেখানে এই বৈঠকের মূল এজেন্ডাই ছিল বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে ক্রেতাদের পকেট কাটা। বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে, টানা দুই বছর ঈদের বেচাকেনা না হওয়ায় সেই ক্ষতির পাশাপাশি আরও অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। স্বাভাবিকভাবেই রাজধানীর নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা লোকের সংখ্যা অগণিত। শুধু ঢাকার মানুষই নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক মানুষ নিউমার্কেটে আসেন শুধু ঈদের কেনাকাটা করতে। একই চিত্র মিরপুর বেনারসী পল্লীর ক্ষেত্রেও। ঈদ, বিয়ে কিংবা উপহার-শাড়ির জন্য নির্ভরযোগ্য ও ঐতিহ্যবাহী বেনারসী পল্লী। এবার সেই সুযোগটিই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন এই দুই এলাকার ব্যবসায়ীরা। অনেকটা নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়েও গিয়েছিলেন। তবে ভোক্তা অধিকারের নিয়মিত অভিযানের কারণে পুরোপুরি লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে পারেননি এই অসাধু চক্র।

অথচ রাজধানীর অভিযাত এলাকা হিসেবে খ্যাত উত্তরা, গুলশান কিংবা বনানীর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নগ্রহের মতোই। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বেচাকেনা হচ্ছে পণ্য। দাম বৃদ্ধির অভিযোগও নজরে আসেনি ভোক্তা অধিকারের। তবে এলাকার দোকান ভাড়াসহ যাবতীয় খরচের কথা বিবেচনায় আনলে মিরপুর ও নিউমার্কেটের তুলনায় অভিজাত এসব এলাকায় খরচ হওয়ার কথা ছিল আরও বেশি। তবে সিন্ডিকেটে যুক্ত না হওয়ায় সে দৃশ্য চোখে পড়েনি। অন্যদিকে ঈদের আগে থেকেই বিভিন্ন অনলাইন শপ থেকে যেরকম দামে পণ্য কেনা যেত এখনও তার তেমন কোন ব্যতিক্রম হয়নি। অন্যদিকে সরেজমিনে ঈদের পোশাকের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে আগত পণ্যের শতকরা ৯০ ভাগই দেশীয়। সুতরাং বাড়তি খরচেরও সম্ভাবনা কম। তবুও বিদেশী পণ্যের পাশাপাশি দেশী পণ্যেও লাগামহীন মুনাফা করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর মিরপুর শপিং কমপ্লেক্সে কথা হয় আরিফুল ইসলাম ও মৌসুমি ইসলাম দম্পতির সঙ্গে। আরিফুল জানান, ঈদে পরিবারের সবার জন্য কেনাকাটা করেছি। প্রায় ১২ হাজার টাকার শপিং করেছি। ছোটদের পোশাক তুলনামূলক দাম এবার একটু বেশি। জানালেন, প্রায় প্রতিটি পণ্যে বিক্রেতারা স্ক্র্যাচ কার্ড দিয়েছেন। ঈদের পরে লটারির ড্র হবে। তবে পুরস্কার আদৌ পাব কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি নিজেই। রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন গৃহিণী সুরভী ইসলাম। তিনি জানান, পরিবারের সবার জন্যই পোশাক কিনেছি। কিন্তু দাম অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি। তিনিও অভিযোগ করে বলেন, মূল্যছাড় দেয়ার নামে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। যার ফলে চড়া দামে পোশাক কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

এসব অনিয়ম রুখতে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করছে। তবুও থামছে না অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। এ পরিস্থিতিতে আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে অধিদফতর। জরিমানার পাশাপাশি মামলা ও কারাদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

ভোক্তা-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আইনে শিথিল প্রয়োগ ও নৈতিকতার অভাবে অতি লোভী হয়ে উঠছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তাদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে জনসচেতনতার পাশাপাশি আইনের আরও কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের কেউ ক্রেতাদের কাছ থেকে আসল পণ্যের দাম নিয়ে নকল পণ্য দিচ্ছেন। আবার কেউ টাকা নিয়েও পণ্য দিচ্ছেন না। অনলাইন এবং প্রথাগত-দুই ধারাতেই যে যার মতো করে ফাঁদ পাতছেন। এসব অনিয়মের মধ্য দিয়ে ভোক্তার পকেট কাটছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। সারা বছরই কমবেশি এ ধরনের অনিয়ম হলেও গত কয়েকদিন তা ব্যাপক হারে বেড়েছে। সাম্প্রতিক অভিযানে নানা ধরনের অনিয়ম ও অপরাধের প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

এভাবে গত এক মাসে বেশ কয়েকটি অনিয়ম পাওয়া গেছে। দেখা যায়, চারগুণ লাভে পোশাক বিক্রি করেছে বনশ্রীর আর্টিসান। একটি শার্টের প্যাকেটের গায়ে লেখা ১৬৯৫ টাকা। কিন্তু ভেতরে ট্যাগে লেখা ১১৯৫ টাকা। এ ছাড়া কোনো কোনো প্যাকেটের গায়ে লাগানো পণ্যমূল্য এবং বারকোড মুছে দেওয়া হয়েছে কালি দিয়ে।

জুতা তৈরিতেও চাতুরতা দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের। রাজধানীর পোস্তা এলাকায় নামকরা ব্র্যান্ড বাটা জুতার নাম নকল করে বালা ও এপেক্সের নাম পরিবর্তন করে এডেক্স ও এপক্স জুতা তৈরা করা হচ্ছে। বাটা এবং এপেক্সের আসল লোগো নকল করে বিভিন্ন জুতায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

অধিদফতর বলছে, কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে জরিমানা করার পর আবারও একই অপরাধ করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৫৭ ধারা অনুযায়ী, মামলা দায়ের হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে অধিদফতরের।

এ বিষয়ে অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ভোক্তাদের স্বার্থে আরও কঠোর হচ্ছে অধিদফতর। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার পরও অনিয়ম কমেনি। তাই ঈদের পর শুধু জরিমানা নয়, আইন অনুযায়ী অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে। ##

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Abu Ahmed Abdullah ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ১০:১১ এএম says : 0
সব মূল্য ছাড়ে এই একই কান্ড ।
Total Reply(0)
নাকিব নাকিব নাকিব ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ১০:১২ এএম says : 0
এই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হোক।
Total Reply(0)
খোরশেদ আলম ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ৪:০৪ এএম says : 0
বেশি বেশি অভিযান পরিচালনা করা হোক
Total Reply(0)
অমিত কুমার ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ৪:০৫ এএম says : 0
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করার কারণে তারা এই প্রতারণা করার সুযোগ পাচ্ছে
Total Reply(0)
জাবেদ ২৪ এপ্রিল, ২০২২, ৪:০৬ এএম says : 0
সরকার ও প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সাধারণ মানুষ এই প্রতারণা থেকে রক্ষা পাবে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন