স্টাফ রিপোর্টার : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক রাডার টাওয়ার স্থাপনের নামে চলছে প্রায় ১৪শ’ কোটি টাকা লুটপাটের অসৎ আয়োজন। প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর মাধ্যমে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৩শ’ কোটি টাকায় অনুমোদন করা হয় ২০১২ সালে। পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে এখন পিপিপির মাধ্যমে ১৭শ’ কোটি করার জন্য সিভিল এভিয়েশন পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তিনশত কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের পর রহস্যজনক কারণে এখন তা ১৭ শত কোটিতে করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে একটি চক্র।
বিষয়টি বিমান মন্ত্রণালয়ের নজরে যাওয়ার পর প্রকল্পের ব্যয় পুনরায় মূল্যায়নের জন্য বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সিভিল এভিয়েশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। গত ৬ নভেম্বর বিমানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান জাকিয়া আফরোজ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সিভিল এভিয়েশনকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চিঠির নির্দেশে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা হবে তার মূল্য তালিকা এবং কোম্পানির নামসহ একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য সিভিল এভিয়েশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাডারের যন্ত্রাংশ এবং কোন কোন কাজে কি কি ব্যবহার করা হবে এর মূল্য তালিকা এবং প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করে বিস্তারিত মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও অন্যান্যদের প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় ব্যয়ের একটি তালিকাও মন্ত্রণালয়কে দিতে বলা হয়েছে। তারপরেও তাড়াহুড়া করে এ প্রকল্পটি ১৭ শত কোটি টাকায় বাস্তবায়নের জন্য সিভিল এভিয়েশনের সহযোগিতায় একটি প্রভাবশালী চক্র মাথা বেঁধে মাঠে নেমেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন এবং অত্যাধুনিক রাডার স্থাপন এখন সময়ের দাবি। রাডার স্থাপন প্রকল্পটি পিপিপি-এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য বলা হচ্ছে। তবে এজন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যয় দেখিয়ে কেউ যাতে অবৈধ কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে না পারে সে জন্য সিভিল এভিয়েশনকে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে এবং আমরা তা পর্যবেক্ষণ করছি। এ ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রকল্প ব্যয় মূল্যায়ন করার জন্য। তবে রাডার টাওয়ার স্থাপন এখন জরুরি হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, পিপিপি এর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলেও টাকার পরিমাণ আরো কিভাবে ১৭ শত কোটি টাকা করা হয়েছে এর বিস্তারিত জানাতে সিভিল এভিয়েশন কে বলা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, রাডার টাওয়ার স্থাপনসহ সকল কারিগরি বিষয় সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দেখছে। এতে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হবে না, নতুন করে প্রকল্পের পিপিপি (পার্টনার) নেয়া হবে।
এদিকে সিভিল এভিয়েশনের একটি সূত্র জানায়, একটি অসাধু চক্র এবং প্রকল্প পরিচালক মাত্র ৩ শত কোটি টাকা বিনিয়োগ বিপরীতে ১৭শ’ কোটি টাকায় প্রকল্পটি অনুমোদনের পাঁয়তারা করছে। মূলত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নামে তারা শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ তৈরি করেছে। আর এ ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশ (সিএএবি) রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে।
সিভিল এভিয়েশন একটি সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পটি ২০১২ থেকেই সিএএবি-এর বহুল আলোচিত ভুয়া ও অসত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে বানানো। সিএএবি-এর কাছে যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণ দেখিয়ে রাডার কন্ট্রোল টাওয়ার এবং সংশ্লিষ্ট কমিনিকেশন ইকুয়ুপমেন্ট নামে প্রথম থেকেই এই কাজটি পিপিপি-এর মাধ্যমে করার চেষ্টা শুরু হয়। সিএএবি এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের পিপিপি-এর মাধ্যমে করতে চায় যা কিনা তাদের বাৎসরিক আয়ের শতকরা ৮০ ভাগের যোগান দেয়। সবচেয়ে বেশি আয়ের এই প্রকল্পটি পিপিপি-এর মাধ্যমে করলে ব্যাপক লুটপাটে সুযোগ পাবে পিপিপি মালিক পক্ষ। কারণ তারা এই বাৎসরিক আয়ের একটি বড় অংশর ভাগ পাবে। এটাই পিপিপি এর মাধ্যমে কাজ করানোর প্রধান উদ্দেশ্য বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। প্রথম বছরে ২৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী ১০ বছরে ৪০-৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সিএএবি এর বাৎসরিক আয়ের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে যাবে ওই কোম্পানি। অপরদিকে অবশিষ্ট আয় দিয়ে সিএএবি তাদের ৯টি বিমান বন্দর পরিচালনা ও কোটি কোটি টাকায় স্থাপিত যন্ত্রপাতি পরিচালনা করবে। যে কাজ সিএএবি এর বাৎসরিক আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ যোগান দেয়, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প-এ বিনিয়োগ করার জন্য সিএএবি-এর কাছে ৩শ’ কোটি টাকা নেই এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। তাদের মতে প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনসহ এ ব্যাপারে ব্যয় সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় পুনঃমূল্যায়ন করার প্রয়োজন।
জানা যায়, সিএএবি বিভিন্ন ব্যাংকে ১৩ শত কোটি টাকার অধিক স্থায়ী আমানত হিসাবে রাখা আছে এবং নিয়মিত উন্নয়ন ও পরিচালনার-এর জন্য সিএএবি-এর বাৎসরিক বাজেট থাকে ৬০০-৭০০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন বাজেট থাকে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বলে সিভিল এভিয়েশনের একজন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী জানিয়েছেন।
মন্ত্রণালয়ের একটি সুত্র জানায়, এ প্রকল্পটি বাস্তবান করলে সিভিল এভিয়েশন বা সরকার প্রায় ১৪ শত কোটি টাকার অপচয় হবে। তাড়াহুড়া করে এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি মহল আদাজল খেয়ে লেগেছে।
সূত্র আরো জানায়, ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পিপিপি প্রকল্পের প্রস্তাব পর্যায়ে সিএএবি তার বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রদর্শন করে এবং মন্ত্রণালয় ও সিভিল এভিয়েশন (কেবিনেট কমেটি ফর ইকনমিক এফেয়ার) কে বিভ্রান্ত করে প্রকল্পের এর অনুমোদন আদায় করে। আগামী ১০ বছরের সম্ভাব্য আয় বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে পিপিপি প্রজ্কেটকে লাভজনক দেখানো হয়েছে। প্রথমে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিএএবি পরবর্তি ১০ বছরের জন্য ৫% প্রবৃদ্ধি দেখায়, তারপর ২০১৩ সালের জুন মাসে তারা ৭% প্রবৃদ্ধি দেখায়, আবার একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রণালয় পরবর্তি ১০ বছরের জন্য ১২% প্রবৃদ্ধি দেখায়। চৎড়লবপঃ কে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক দেখানোর জন্য প্রতিনিয়ত প্রবৃদ্ধি হার পরিবর্তন করা হয়েছে।
জানা যায়, পিপিপির মাধ্যমে করলে সিএএবি বিনিয়োগের অর্থ ব্যাংকে রাখলে ১২% হারে ১০ বছরে ৮৫০ কোটি টাকা পাবে বলে দেখায়। কিন্তু বাস্তবে বর্তমানে ব্যাংক-এর স্থায়ী জামানতের সুদের হার ৫% - ৬%। সবচেয়ে ভীতিকর ব্যপার হল যদি পর্যাপ্ত তহবিল না থাকাই প্রাইভেট পার্টনার এবং বিনিয়োগ নেয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হয়, যা তারা সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে সিএএবি (কেবিনেট কমেটি ফর ইকনমিক এফেয়ার মিটিং এ উপস্থাপন করে, তাহলে সিএএবি কিভাবে ১০ বছরে স্থায়ী জামানাত এর লাভের হিসাব দেখায়, প্রথমত যে তহবিল তাদের কাছে নেই বলে তারা তাদের প্রাথমিক প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছিলো। যে তহবিল তাদের কাছে নেই, তা ব্যাংক এ স্থায়ী জামানত করা কীভাবে সম্ভব।
সূত্র আরো জানায়, পিপিপির মাধ্যমে এ কাজটি করার জন্য সিএএবি তাদের প্রস্তাবনায় বাৎসরিক ব্যয় এবং তা ১০ বছরের বৃদ্ধির আনুপাতিক হার উল্লেখ না করে শুধু ১০ বছরের ১২% হারে প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে আয় দেখায়। কিন্তু সূত্র মতে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সিএএবির খরচ ছিল ৬০০ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০০০ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২০০ কোটি। এ থেকেই বুঝা যায় যে বাৎসরিক ব্যয়ে বৃদ্ধির আনুপাতিক হার, বাৎসরিক আয় বৃদ্ধির দ্বিগুণ। সুতরাং নিজ অর্থায়নে না করলে আগামী ১০ বছরে এই প্রোজেক্ট কোনোভাবেই সিএএবির জন্য লাভজনক হবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, সিভিল এভিয়েশনের প্রকল্প পরিচালক মঞ্জুর রহমান বলেন, এ প্রকল্পের পিডি আমি হলেও বিষয়টি পুরোপুরি মন্ত্রণালয়ের হাতে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। আমার কিছুই বলার নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন