শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ঈদের আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সঙ্কট

বিপনন কোম্পানিগুলো খুচরা বাজারে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

রমজান মাসে ইফতারে ভোগ্যতেলের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। এবার রোজার আগে ভোগ্যতেল নিয়ে ব্যবসায়ীরেদ তেলেসমাতির পর বাজারে তেলের স্বাভাবিক সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু রমজানের শেষ দিকে এসে ঈদের আগে হঠাৎ করে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করে পাম অয়েল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। বিকল্প পথ না থাকায় বেশি ডলারের বিনিময়ে ভোজ্যতেলের জোগান মেটাতে হচ্ছে তাদের। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভোজ্যতেলের সঙ্কটে ভুগবে সমগ্র বিশ্ব। পাম তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ইন্দোনেশিয়ার রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বড় ধরনের সরবরাহ সঙ্কট তৈরির শঙ্কা তৈরী হয়েছে। এদিকে ভোজ্যতেল আমদানি ও বিপণন ব্যবসায়ীরা কয়েক মাস থেকে দেশের বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ঈদের আগে সরকার তেলের দাম আর বাড়াবে না এ সিদ্ধান্তে অনড়। তাই ভোজ্যতেল বিপনন কোম্পানিগুলো খুচরা বাজারে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তেলের বাজার নিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক সঙ্কট এবং আর্জেন্টিনা ও কানাডায় ভয়াবহ খরার কারণে বিশ্ববাজারে তেল রফতানিতে দেখা দিয়েছে মারাত্মক সরবরাহ সঙ্কট। এ অবস্থায় দেশগুলোর প্রধানতম ভরসাস্থল ছিল ইউক্রেন ও রাশিয়ার সূর্যমুখী তেল। কিন্তু গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু করলে শেষ আশাও মরীচিকার মতো হারিয়ে যায়। এতে হারাধনের শেষ ছেলের মতো ইন্দোনেশিয়ার কাছে পাম অয়েলের জন্য নির্ভরশীল হতে না হতেই দেশটি থেকে এমন ঘোষণায় হতাশ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরা বাজারের সরকার নির্ধারিত দাম লিটার প্রতি ১৬০ টাকা। কিন্তু গত রোববার পাইকারি বাজারেরই লিটারে তেলের দাম পড়ছে ১৯৭ টাকা করে। ফলে খুচরা বাজারে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। বিশ্বের শীর্ষ পাম তেল উৎপাদনকারী দেশটির রফতানি নিষেধাজ্ঞা আগামী ২৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু এরই মধ্যে বাড়তি থাকা ভোজ্যতেলের দাম আরও বেড়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার দেশের সবচেয়ে বড় নিত্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পাম ও সয়াবিন তেলের মূল্য মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩ কেজি) ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে তেলের পাইকারি মূল্য সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যের চেয়ে লিটারে অন্তত ২০ টাকা বেড়েছে। তাৎক্ষণিক প্রভাব হিসেবে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি অংশে সরবরাহ কমে গেছে এবং ঢাকা ও অন্যান্য জেলার খুচরা দোকানগুলোতে ভোজ্যতেলের বোতল ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঢাকার বাইরে রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, ফরিদপুর, রংপুরসহ প্রায় সারাদেশেই সয়াবিন তেলের সঙ্কটের কথা বলছেন দোকানি ও ক্রেতারা। বেশি দাম দিয়েও তেল কিনতে না পারার অভিযোগ করেন অনেক ক্রেতা। দোকানিরা বলছেন, গত প্রায় এক সপ্তাহ তেল সরবরাহ না থাকায় তেল দিতে পারছেন না তারা।
ভোজ্যতেল আমদানি ও বিপণনে দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (অপারেশনস) তারিক আহমেদ বলেন, গত দুই দিনে পাইকারি পর্যায়ে পণ্যটির অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে পাইকারিতেই পণ্যটির দাম অনেক বেশি। ফলে সরবরাহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সরকার শিগগিরই দাম সমন্বয়সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা করছি।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা শুধু তেল বিক্রি করছেন না। তেলের সাথে অন্য পণ্য কিনলে তবেই তেল বিক্রি করছেন। সরবরাহ সংকটে তেল বিক্রিই করছেন না অনেক দোকানী। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে রূপচাঁদা, তীরসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। তাদের চাহিদার অর্ধেক বা চারভাগের এক ভাগও পাচ্ছে না তারা। আবার যা কিনতে পারছে সেটাও গায়ে লেখা দামে কিনতে হচ্ছে। এমনকি রাজধানীর টিসিবি’র গাড়ী থেকেও অন্যান্য পণ্য কিনলেই মিলছে তেল।
হাজী মিজান এন্টারপ্রাইজের বিক্রয়কর্মী মোহম্মদ মনির হোসেন বলেন, বোতলজাত পাঁচ লিটার তেলের গায়ে ৭৬০ টাকা লেখা। আমরা এর চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনছি। আবার লেবার খরচ দিয়ে দোকানে নিয়ে আসতে প্রতি লিটার তেলে ২ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হয়। ফলে সব ক্রেতাকে তেল দিতে পারছি না। যারা বেশি কেনাকাটা করছেন তাদের কাছে তেল বিক্রি করছি। এটিকে গ্রাহক ধরে রাখার কৌশল হিসাবে বলছেন তিনি।
একই বাজারের ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের বিক্রয় কর্মী আলি হোসেন জানান, এক সপ্তাহ ধরে কোন কোম্পানির প্রতিনিধি আসে না তার দোকানে। জব্বার স্টোরের বিক্রয় কর্মী বলেন, প্রতিদিন ৬০০ লিটার তেল বিক্রি হয়। কিন্তু তেল কিনতে পারছি ৪০ লিটার, সেটাও গায়ে লেখা দামে। তিনি বলেন, ৭ দিন ধরে কোন তেল কোম্পানির প্রতিনিধি আসছেনা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকার খুচরা বাজারগুলোতে খোলা সয়াবিন পাওয়া যাচ্ছে না। বোতলজাত এক লিটারের সরবরাহও কম। বাজারে অধিকাংশ দোকানেই রয়েছে দুই লিটার ও পাঁচ লিটারের বোতল। খুচরা দোকানিরা বলছে, কোম্পানিগুলো মাসখানেক ধরেই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে এক লিটারের বোতলের সঙ্কট রয়েছে। তবে অধিকাংশ দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেল সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে দেখা গেছে।
ঢাকার হাতিরপুল বাজারে সয়াবিন তেলের ডিলার আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের যে চাহিদা রয়েছে তার থেকে অন্তত ৩০ শতাংশ কম সরবরাহ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। যে কারণে ক্রাইসিস রয়েছে। ঢাকার ইস্কাটন এবং মগবাজারের সুপারশপগুলোতে ঘুরেও সয়াবিন তেলের ছোট বোতল পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবারের পরে আর সয়াবিন তেল আসেনি সুপারশপগুলোতে।
স্বপ্ন ইস্কাটন শাখার ম্যানেজার মো. আজাদ বলেন, শুক্রবার আসা সাপ্লাই হওয়া তেলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফ্রেশ ও তীর ব্র্যান্ডের কিছু বোতল রয়েছে। বাকি সব ব্র্যান্ডের তেল শেষ। নতুন সাপ্লাই নিয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। তবে এরই মধ্যে তেলের স্টক প্রায় শেষ মীনা বাজারে। প্রতিষ্ঠানটির মগবাজার ব্র্যাঞ্চে গিয়ে দেখা গেছে, তীর ব্র্যান্ডের ৫ লিটারের চারটি বোতল তেল রয়েছে। তবে ছোট বোতলের সরবরাহ নেই।
মগবাজার ব্র্যাঞ্চের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত শুক্রবারের পর আর তেল আসেনি। এখন নতুন চালান না আসলে সঙ্কট তৈরি হবে। তবে সরবরাহ কমানোর কথা অস্বীকার করেন উৎপাদকরা। দেশের সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী তীর ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, আমরা তেলের সরবরাহ কমাইনি। তিনি বলেন, আমরা আজকে যে তেল বাজারে ছেড়েছি তাতে লিটার প্রতি ৪০ টাকা লোকসান হচ্ছে। সরকার ঈদের আগে তেলের দাম আর বাড়াবে না। তাই কেউ কেউ হয়তো তেলের সরবরাহ বন্ধ করেছে। তবে আমরা তা করিনি।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫০ শতাংশ পাম অয়েল আমদানি করে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ৮০ শতাংশ। আর তাই ইন্দোনেশিয়ার এমন ঘোষণার পরপরই ভারতে পাম অয়েলের দাম ৫ শতাংশ হারে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের খোলা বাজারে কেজিপ্রতি সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। একই অবস্থা বিরাজ করছে পাকিস্তানের বাজারেও।#

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন