শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দেশের ৩৫ জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ

হঠাৎ বন্যার আশঙ্কায় পাউবোর কর্মকর্তাদের ঈদের ছুটি বাতিল প্রকল্পের তালিকা দিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গড়িমসি

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

ভারত যেভাবে সময়ে অসময়ে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিচ্ছে; তাতে করে দেশে হঠাৎ করে বন্যা হতে পারে। অথচ দেশের ৩৫ জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ। গত দুই বছর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভয়াবহ নদীভাঙন থেকে রক্ষায় দেশের ৩৩টি জেলাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রাকৃতির ভয়াবহতা ও বিপজ্জনক বিবেচনায় সমগ্র দেশকে ৬টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সংস্কার এবং মেরামত কাজ এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। এসব বাঁধের কাজ শেষ হতে না হতে আসন্ন বন্যার আশঙ্কায় দেশের ৩৫ জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ। সামান্য বড় বৃষ্টি হলে এসব বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা। তবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে টাকার বরাদ্দ দিতে ঘোষণা দিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের তালিকা দিতে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা গড়িমশি করছে বলে জানা গেছে।

মন্ত্রণালয় ও পাউবো কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে নদীভাঙন রোধ, নদী শাসন, নাব্য রক্ষাসহ সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি বাংলাদেশ ব-দ্বীপ-২১০০ গ্রহণ করা হয়েছে। এই নীতির আলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির সম্মুখীন এলাকাগুলোকে এক-একটি গ্রুপের আওতায় এনে টেকসই পদক্ষেপ নেবে সরকার।

আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সারা দেশে বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এবং বন্যার আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেশের সকল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীদের চিঠি দিলেও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করতে পারেনি এসব কর্মকর্তারা। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা দ্রুত পাঠাতে ব্যর্থ হবেন তারা শাস্তির সম্মুখীন হবেন। তাও পাঠাতে পারেনি ২২ জেলার। গতকাল মঙ্গলবার আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সারা দেশে বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এবং বন্যার আশঙ্কায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে না পাউবোর সচিব স্বাক্ষরিত দপ্তরাদেশ জারি করা হয়েছে।

গত দুই বছর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভয়াবহ নদীভাঙন থেকে রক্ষায় দেশের ৩৫টি জেলাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রাকৃতির ভয়াবহতা ও বিপজ্জনক বিবেচনায় সমগ্র দেশকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা নদীর অঞ্চল ও মোহনাগুলোকে সমন্বিত ও টেকসই ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ তে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে কর্মকৌশল। এ কর্মকৌশল বাস্তবায়ন হলে নদী ও নদীর মোহনায় পানি প্রবাহের সক্ষমতা বাড়বে। ফলে নদীগুলোকে স্থিতিশীল রাখা এবং যথাযথ পলি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ সহজ হবে। এসব পদক্ষেপে দেশে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমবে। আর নদীভাঙন কবলিত এলাকায় এ পদক্ষেপের মাধ্যমে ভাঙনরোধ সম্ভব হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা হয়। চলতি বছর এ বন্যা জুন থেকে শুরু হয়। এখনো অতি বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন জেলায় বন্যা অব্যাহত আছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুরে রেকর্ড বৃষ্টিতে নাকাল সেখানকার মানুষ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত থেমে নেই। ফলে কর্মব্যস্ত মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম ইনকিলাবকে বলেন, আসন্ন বন্যায় ক্ষতি আরো কমাতে হবে এর জন্য আগাম প্রস্তুতিসহ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যাহারা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা দ্রুত পাঠাতে ব্যর্থ হবেন তারা শাস্তির সম্মুক্ষিণ হবেন। বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে টাকার প্রয়োজন হলে টাকা দেয়া হবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি পানি ভবনের সভাকক্ষে মাসিক সংশোধীত এডিপি পর্যালোচনা সভায় বলা হয়, আসন্ন বন্যায় ক্ষতি আরো কমাতে হবে এর জন্য আগাম প্রস্তুতিসহ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যাহারা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা দ্রুত পাঠাতে ব্যর্থ হবেন তারা শাস্তির সম্মুক্ষিণ হবেন। বাঁধ নির্মান ও মেরামতে টাকার প্রয়োজন হলে টাকা দেয়া হবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরডিপি পর্যালোচনা সভায় নির্ধারিত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রীসহ অনেক কর্মকর্তারা।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫ জেলার মধ্যে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, জামালপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, রাজবাড়ী, পাবনা, মাদারীপুর, কুষ্টিয়া ও কক্সবাজার।

আরডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বলা হয়, চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৭৩৮৭.৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মোট ১১৪ টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১টি প্রকল্প পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার। ২০২২ সাল নাগাদ সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত পকল্প ২৯টি এর মধ্যে ৫টি প্রকল্প সমীক্ষাধর্মী, আরডিপি বর্হিভূত নতুন অনুমোদিত প্রকল্প ১১টি। গত এপ্রিল ১৬ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৬১.৯০ শতাংশ। পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার প্রকল্পটির অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় অঞ্চল ঢাকার এডিপি ৯টি,আরডিপি ১১টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৭.৪৫ শতাংশ, পূর্বাঞ্চল কুমিল্লায়। এডিপি ১০টি,আরডিপি ১১টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৫০.৯৭শতাংশ, উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেটে এডিপি ৪টি, আরডিপি ৪টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৭২.৫৯ শতাংশ, দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামে এডিপি ৮টি, আরডিপি ১৩টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৯.৫০ শতাংশ,উত্তরাঞ্চল রংপুরে এডিপি ৮টি,আরডিপি ১৩টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৫.৩৪ শতাংশ, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহীতে এডিপি ৯টি, আরডিপি ১০টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৮.৪৪ শতাংশ, পশ্চিমাঞ্চল ফরিদপুরে এডিপি ৯টি, আরডিপি ১১টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৬.৪৯ শতাংশ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল খুলনায় এডিপি ৬টি, আরডিপি ৭টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৮.৫৪ শতাংশ, দক্ষিণাঞ্চল বরিশালে এডিপি ৮টি, আরডিপি ৯টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৫.৯০ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ সহায়তা প্রকল্প এডিপি ৭টি, আরডিপি ৯টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৯.৬২ শতাংশ এবং বিশেষ প্রকল্প এডিপি ৩টি, আরডিপি ১৫টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৩.১৫ শতাংশ। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিগত পাঁচ বছরের অগ্রগতি এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬১.৮৯ শতাংশ

আসন্ন বন্যায় দেশের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাঁচা ঘরবাড়ির পাশাপাশি গবাদিপশু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে দুর্যোগ মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে সরকার।

গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির হওয়ার ও বন্যার আশংকা থাকায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা-১ নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ হলো। চিঠিতে আরো বলা হয়, আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরের ছুটিতে বাপাউবো’র মাঠ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে না। যদি কারো বিশেষ প্রয়োজন হয় তা হলে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে ছুটিকালীন বিকল্প উপস্থিতি থাকা সাপেক্ষে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হবে।

গত ২০২০ সালের ২২ আগস্ট পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় ৩৩ জেলার নদীভাঙন কবলিত এলাকার ছয় ক্যাটাগরিতে ক্ষতি নির্ধারণ করে জরুরি পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩.০১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদী তীর ভাঙনরোধ, নদী তীর সংরক্ষণ কাজের ক্ষতি, বাঁধের ব্রিজ, বাঁধের সম্পুর্ণ ও আংশিক ভাঙন এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো উন্নয়নে ১০৯ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আরো ৮৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫৪ দশমিক ০৩০ কিলোমিটার নদী তীরের মেরামত ও পুনর্বাসন কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় নদীভাঙনরোধ, বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি রোধে সার্বক্ষণিক নজরদারি বহাল রেখেছে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চলমান মেরামত কাজেও সর্বদা নিয়োজিত রয়েছেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেবে সরকার। এর জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পাউবোর বাস্তবায়নাধীন ১০১টি প্রকল্পের মধ্যে ৫৩টি নদী তীর সংরক্ষণধর্মী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কিন্তু এসব প্রকল্পে এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি পাউবো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন