পবিত্র ঈদ উল ফিতরের আর মাত্র এক থেকে দুই দিন বাকি। আর ঈদ উপলক্ষ্যে নিজেদের সন্তাদের সাথে নিয়ে ঈদ শপিং করছেন পিতা-মাতারা। তবে বাবার সাথে ঈদের কেনাকাটা না করতে পেরে আক্ষেপ করেছেন গুম হওয়া আনোয়া হোসেনের মেয়ে রাইসা। গতকাল দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে মায়ের ডাক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কেঁদে কেঁদে রাইসা বলেন, ‘আজকে সবাইকে তাদের বাবা ঈদের শপিং করতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কাকে নিয়ে ঈদের শপিং করতে যাব? আমি কি বাবার সঙ্গে ইফতার করতেও পারব না। ঈদের নামাজ পড়ে এসে বাবা কি আমাদের সঙ্গে খাবে না?’ স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আমার বান্দবীরা তাদের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আমার বাবা না থাকায় তাকে জড়িয়ে ধরতে পারি না। ঘরে যখন বাবা না থাকে তখন একটা মেয়ে বুঝতে পারে; তার কেমন লাগে। কেনো আমার বাবাকে মারা হয়েছে। আমার বাবা বিএনপি করতো এটাই তারা অপরাধ!’
রাইসা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবা বিএনপির ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালে চোখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সাথে সাথে আমার মা এক সাংবাদিক আঙ্কেলকে ফোন দেন। এ জন্য সেই সময় আমার বাবাকে তারা হত্যা করতে পারেনি। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে তার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখাই ভালোভাবে চিকিৎসা করানো হয়নি। তাই আমার বাবা মারা গেছেন। রাইসা বলেন, রাজনীতি করার কারণে আমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই।
শুধু রাইসাই নয়, সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয়া গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের আবেগময় আকুতিতে উপস্থিত অনেককে অশ্রুসজল হতে দেখা গেছে। কেউ কেউ তার বাবার ছবি, কেউ তার ভাইয়ের ছবি, কেউ তার সন্তানের ছবি, কেউ তার স্বামীর ছবি হাতে নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। সবারই এক কথা- এভাবে আর কতকাল অপেক্ষা করে থাকতে হবে।
গুম হওয়া গুলশান থানা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি সাইফুর রহমান সজীবের বাবা শফিকুর রহমান বলেন, এখানে কি বলব? ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে আমার ছেলেকে গুম করা হয়েছিল। তার প্রশ্ন, আমার ছেলে চোর, ডাকাত, না সন্ত্রাসী? বিএনপি করে, এটাই কি তার অপরাধ? এখনো পর্যন্ত আমার ছেলের সন্ধান পাইনি। ছেলে গুম হওয়ার পর থেকেই তার মা শুধুই কান্না করতো। প্রশাসনের কাছে বার বার আবেদন করা হয়েছে; আমার ছেলেকে এক বারের জন্য দেখান। কিন্তু ভাগ্যেরে নির্মম পরিহাস, ছেলের গুমের বেদনায় তার মা কান্না করতে করতে অসুস্থ্য হয়ে ২০১৮ সালে মারা যায়। এরপর থেকে আমিও একা হয়ে গেছি।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি নজর দেয় সরকার। কিন্তু গুম পরিবারের প্রতি নজর নেই সরকারের। রোহিঙ্গাদের চেয়েও গুম পরিবারের সদস্যদের অবস্থা খারাপ। তা হলে কেন আমাদের জাতীয় পরিচয় পত্র দিয়েছেন? কেন আমাদের পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে? এগুলোর কোনো দরকার নেই। এগুলো নিয়ে যান বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সজীবের বাবা।
পল্লবীর কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন ২০১৯ সালে ‘নিখোঁজ’ হন। সংবাদ সম্মেলনে তার স্ত্রী নাসরিন জাহান বলেন, তিনি তিন বছর ধরে স্বামীর সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ‘গুম’ শব্দটা দুই অক্ষরের, কিন্তু যন্ত্রণা দিনের পর দিন। তার স্বামীর খোঁজ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে নাসরিন জাহান বলেন, আপনার মানবতার হাত কি আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিতে পারেন না? আমরা সিংহাসন চাই না। আমার স্বামী বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন, আমি একটু মিলাদ দেব, একবার সন্ধান দেন। নাসরিন জাহান যখন কথা বলছিলেন, তখন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা চোখ মুছতে থাকেন।
এরপর গুম হওয়া ছাত্রদলের মাহবুবুর রহমান বাপ্পীর বোন ঝুমুর আখতারও আবেগময় কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ভাইকে ২০১১ সালে যখন গুম করা হয়; তখন আমি রাস্তায় ছিলাম। কখনো বাসায় যায়নি। টানা ২২দিন ডিবি অফিস, র্যাব, পুলিশের বিভিন্ন থানায় ঘুরে বেরিয়েছি। থানা ও ডিবি অফিসের বাহিরে রাস্তায় রাত যাপন করেছি। তারপর আমার ভাইকে অনেক অত্যাচার করে মারা হয়েছে। আমার ভাইকে মারার জন্য পরিবারের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমাদের দুঃখ শুনার মতো কেউ নেই।
ভোলা থেকে আসা বৃদ্ধ কয়ছর আহাম্মদ গাজী। ১৯ এপ্রিল রাতে তার ছেলে মো. মহাসিনকে রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দেওয়া লোকজন তুলে নিয়ে যান। মহাসিন পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সংবাদ সম্মেলেনে তার বাবা কয়ছর আহাম্মদ গাজী বলেন, আমার মহাসিন কই? মহাসিন কী অপরাধ করছে?’ কাঁদতে কাঁদতে শুধু এটুকুই বলতে পারেন তিনি।
মহাসিনের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ১০ দিন হয়ে গেছে, কেউ তার স্বামীর বিষয়ে কোনো তথ্যই দিচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি তেজগাঁয় পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফরিদা ইয়াসমিন তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কাফরুল থানায় ২৫ এপ্রিল সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
ফরিদা আরো বলেন, শেওড়াপাড়ায় মাদবরের পুকুরপাড়ের একটি বাসায় তারা থাকেন। ১৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৭-৮ জন তাদের বাসায় আসেন। এ সময় বাসার বাইরে কয়েকটি হায়েস গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। বাহিনীর সদস্যরা জানান, তার স্বামীর নামে ভোলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। তবে তারা পরোয়ানা দেখাননি। তাদের একজনের একটি পরিচয়পত্রের ছবি তোলেন বাসার এক সদস্য। তারা তার মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ওই ছবিও মুছে ফেলেন। পাঁচ দিন পর অভিযোগ করার কারণ জানতে চাইলে ফরিদা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে তিন দিন চুপ করে থাকতে বলেছিলেন। এছাড়াও কয়েক বার থানায় যাওয়ার পরও তারা সাধারণ ডায়েরি নেয়নি। এক পর্যায়ে আমাদের এক আত্মীয় প্রশাসনে চাকরি করেন। উনার অনুরোধে সাধারণ ডায়েরি নিয়েছেন পুলিশ।
সদ্য গুম হওয়া মহসিনের ছোট ভাই বাবলু গাজী বলেন, আমার ভাইকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেই আমার ভাই আছে। আমার ভাই যদি কোনো অপরাধ করে তা হলে তাকে আদালতে হাজির করেন। এভাবে গুম করে না রাখার অনুরোধ করেন তিনি।
পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের আগে গুম হওয়া সকলকে ফেরত ও গত ১৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়া মাতবরের পুকুরপাড় থেকে গুম হওয়া ব্যবসায়ী মো. মহসিনের সন্ধানে সংবাদ সম্মেলনে মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখির সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা’র সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, অধিকারের সভাপতি প্রফেসর ড. সি আর আবরার, মানবাধিকার নেতা নূর খান লিটন, রেজাউর রহমান লেলিন, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলেন প্রমুখ।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, আর কত কাঁদবেন? আমি নিজেকে শক্ত হয়ে আছি। কিন্তু, কখন যে চোখ ভিজে যায় বুঝতে পারি না। চোখের পানিকে বারুদে পরিনত করতে হবে।
তিনি বলেন, এই প্রধানমন্ত্রী কি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী? তিনি হচ্ছেন র্যাব-পুলিশের প্রধানমন্ত্রী। আপনারা তাকে ভোট দেননি। আপনাদের ভোটের প্রয়োজনও তার হয় নাই। ঈদের আগে আপনারা আপনাদের স্বজনকে ফেরত চাচ্ছেন। দুই দিন পর ঈদ, তিনি কি আপনাদের কথা শুনবেন ? আপনারা তার কাছে জবাব চান। আর জবাব না দিলে ঈদের পর একসাথে সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন।
তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে এ সরকার থাকলে কোনদিনও আপনাদের স্বজনরা ফিরে আসবে না। গুম হওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে আনতে হলে রাজপথে আসতে হবে। আপনাদের সাথে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজসহ সবাই থাকবেন।
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, গুমের কথা স্বীকার না করে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। জনগণের প্রতি ন্যূনতম সম্মান থাকলে এভাবে কথা বলা যায় না। গুমের বিষয়ে সরকার যদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহি করতে পারে, তাহলে দেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি করছে না কেন বলে প্রশ্ন করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান বলেন, রাষ্ট্র যখন তার কৌশল হিসেবে গুমকে ব্যবহার করে, তখন এটি বন্ধ করা যায় না, যতক্ষণ না রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর ৬১৪ জন নিখোঁজ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জীবিত ও মৃত অবস্থায় ওই ব্যক্তিদের বেশির ভাগের খোঁজ মিললেও অন্তত ২০০ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন